মানিককোল গ্রামের মিষ্টি মেলা

কার্তিক পুজোর দিন গোপালনগর স্টেশন থেকে ২০ নম্বর বাসে উঠে মেদিয়া বাজার স্টপেজের টিকিট চাইতে দেখলাম কন্ডাক্টর ভদ্রলোক একটু অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকালেন, কারনটা বুঝতে না পারলেও অনুরোধ করলাম স্টপেজ এলে একটু বলতে। স্টেশন থেকে গন্তব্যের দূরত্ব খুব বেশী নয়, একটু বাদেই বাসের হেল্পার ‘মেদে বাজার’, ‘মেদে বাজার’ বলে হাঁক পাড়াতে বুঝতে পারলাম আমার মুখে শুদ্ধ নাম শুনেই ভদ্রলোক একটু অবাক হয়েছিলেন। বাস থেকে যখন নামলাম ঘড়ির কাঁটায় তখন সবে সকাল ৭ টা, তিনটে চায়ের দোকান ছাড়া সমস্ত এলাকাটাই শীতের আলিস্যি গায়ে মেখে ঘুমিয়ে আছে, মেলার কোন ব্যস্ততাই কোথাও নেই। যদিও গোপাল নগরের আদি বাসিন্দা, ভাতৃপ্রতিম কৌশিক সাধুখাঁ মেলার সঠিক তারিখ জেনেই আমাকে খবর দিয়েছিল, তাও মনে একটা খটকা যে লাগছিলনা তা নয়, অন্ধকার থাকতে বাড়ী থেকে বেরিয়েছি, এক কিলোমিটারের বেশী হেঁটে বারাসাত স্টেশন, ট্রেনে বনগাঁ, সেখান থেকে ট্রেনে গোপালনগর তারপরে আবার বাস, শেষে যদি শূন্য হাতে ফিরতে হয়। অগত্যা, চায়ের খুব একটা ভক্ত না হলেও খবর নেওয়ার জন্য চায়ের দোকানেই ঢুকতে হল, চা পানের পরে মেলার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই দেখি দোকানদারের দৃষ্টিতে কেমন যেন সন্দিগ্দ্ধতা, জিজ্ঞেস করলেন ওই গ্রামে কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে যাব কিনা, পরে বুঝেছিলাম মুসলিম গ্রামে মেলা দেখতে যাব শুনে আমার ধর্ম নিয়েই উনি একটু সন্দিগ্দ্ধ হয়েছিলেন। শুধুমাত্র এই মেলা দেখতেই এসেছি এটা যেন ভদ্রলোকের কাছে অবিশ্বাস‍্যই ঠেকছিল, যাই হোক এই মেলার থেকে আরও অনেক ভালো ভালো মেলা দেখার পরামর্শ আর খানিকটা পথনির্দেশ নিয়ে ওনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

বাকি রাস্তাটা গুগলের ভরসায় পায়ে হেঁটেই রওনা দিলাম, বাজারের মাঝখান দিয়ে পীচের ঝকঝকে রাস্তা। বাজারের এলাকা ছেড়ে খানিকটা যেতেই পুরো পরিবেশটাই পাল্টে গেল, দুপাশের গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে সকালের জনবিরল রাস্তা, খানিকটা ছাড়া ছাড়া কয়েকটি করে বাড়ী ঘর, কারোর উঠোনে তুলসী মঞ্চ তো কারোর বাড়ীর দেওয়ালে লেখা ‘এলাহী ভরসা’ বুঝিয়ে দিচ্ছিল এলাকায় মিশ্র ধর্মের মানুষের বাস। বাতাসের গন্ধটাও যেন কেমন চেনা চেনা লাগছিল, অনেকটা কি ছোটবেলার আনুলিয়ার মত ? কি জানি, হয়ত আমার মনের ভুল, সব জাগাতেই আনুলিয়ার গন্ধ পাই। প্রায় ২ কিলোমিটার মত হাঁটার পর গাছপালার ফাঁক দিয়ে মেলার নাগর দোলার দেখা পেতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল।

আরও একটু এগিয়ে পিচ রাস্তা থেকে ডানদিকে কাঁচা রাস্তায় নেমে খানিকটা যেতেই মেলার দোকান গুলোর দেখা পেলাম, রাস্তার উপরে প্রথমেই কয়েকটা মাছের আর মুরগির মাংসের দোকান, তারপর কয়েকটা কাঠের, লোহার আর মাটির জিনিসপত্রের দোকান পার হয়ে মূল মেলার জায়গা, দোকানিরা তখনও পসরা সাজাতে ব্যস্ত। দক্ষিণ মানিককোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশস্ত মাঠের তিন দিকে বসেছে মেলা, কিন্তু প্রায় সব দোকানেরই ঝাঁপ নামানো। মাঠে ঢুকতেই দেখি সেখানে প্রথমেই কয়েকটা সব্জীর দোকান। মিষ্টির মেলায় মাছ, মাংস আর সব্জীর দোকান কেন সেটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। যাইহোক, মেলার মাঠে প্রবেশ করে দেখি প্রায় সবারই গন্তব্য স্কুলের পাশ দিয়ে পিছনের দিকে, কেউ পায়ে হেঁটে চলেছে তো কেউ সাইকেলে কেউ আবার মোটর সাইকেলে প্রত্যেকেরই সঙ্গে গামলা বা বালতি এবং প্রায় সবাইই ব্যস্ত, কৌতূহলে আমিও ওদের সঙ্গে পা মেলালাম। দেখি মেলার মূল আকর্ষণ ওই পিছনের মাঠেই, মনোহারী দোকান, নাগর দোলা, ফুচকা, ঘুগনী সবই ওই পিছনের মাঠে, যদিও সেখানেও সবাই গোছগাছে ব্যস্ত। আর মেলার একপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে বসেছে মিষ্টির মেলা, সব ভিড় ওখানেই, এক এক জন মিষ্টি বিক্রেতাকে অর্ধ বৃত্তাকারে ঘিরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ক্রেতারা।

আমিও ভিড়ের সঙ্গে মিশে ঘুরতে লাগলাম এক অর্ধ বৃত্ত থেকে আর এক অর্ধ বৃত্তে, একটু দাঁড়ালেই অনুরোধ আসছে খেয়ে দেখার জন্য, সঙ্গে জোর গলায় নিজের মিষ্টির গুণগান চলছে, বিক্রিও হয়ে চলেছে বালতি, গামলা ভর্তি করে। মিষ্টি মূলত রসগোল্লা, পান্তুয়া আর কিছু ল্যাংচা এখানকার চলতি কথায় সাদা মিষ্টি আর কালো মিষ্টি, যার দাম শহরের থেকে অনেকটাই কম। মিষ্টি নেওয়ার আগে প্রায় সব ক্রেতারই জিজ্ঞাস্য মিষ্টি কতদিন ভালো থাকবে আর নেওয়ার পর আবদার একটু বেশী করে রস, মুড়ি দিয়ে খেতে হবে যে।

মনের আনন্দে মেলা ঘুরলেও কি উপলক্ষে মেলা সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না, একজন স্থানীয় মানুষকে ডেকে আলাপ করে মেলার কথা জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারলাম স্থানীয় বড় পীরের উরস উপলক্ষে প্রতি বছর বসে এই মেলা, কত বছর ধরে চলছে এই মেলা তা সবার কাছেই অজানা। যদিও পীর আজ অনেকটাই বিস্মৃতি আর অবহেলার অন্ধকারে, উৎসবের দিনেও কেউ কবরের আগাছা পরিষ্কার করে না, তবুও এই মেলা উপলক্ষে গ্রামের মানুষের বাড়ীতে অতিথি সমাগম হয়, গ্রামের মেয়েরা বাপের বাড়ী আসে, কর্ম সূত্রে বাইরে থাকা মানুষজন ঘরে ফিরে আসেন, এক কথায় এই মিষ্টি মেলা মূলত মুসলীম ধর্মাবলম্বী মানিককোল গ্রামের মানুষের কাছে এক মিলন মেলা, সেই কারনেই মিষ্টির সঙ্গে ওই মাছ আর সব্জীর পসরা, অতিথি কুটুম আপ‍্যায়নের জন‍্যে। ভদ্রলোকের সঙ্গে খানিকক্ষণের আলোচনাতে উঠে এল পীরের প্রতি গভীর বিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা ক্ষোভও, সেটা পীরের প্রতি অবহেলার, এমনকি এবছরের মেলাও নাকি হবার কথা ছিলনা, একেবারে শেষ সময়ে গ্রামবাসীদের চাপে মেলার আয়োজন করা হয়েছে, সেই কারনে মেলার দোকানও অন্যবারের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম বলে তিনি জানালেন।

মেলার কাছেই বড় পীরের কবর, সেই কবর দেখতে গিয়ে আলাপ হল মুসা ভাইয়ের সঙ্গে। মেলা থেকে বেরিয়ে পীরের কবর দেখতে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলাম এমন সময় মুসা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, আলাপ হলে জানতে পারলাম কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশ ঘোরা ভদ্রলোক বাংলাদেশের নাগরিক হলেও জন্ম মানিককোল গ্রামে, ওনার কয়েকজন সহোদর ওই গ্রামেই বাস করেন, সেই সূত্রেই দীর্ঘদীন বাদে গ্রামে আসা। আমার পীরের কবর খোঁজার কথা শুনে ভদ্রলোক নিজেই উৎসাহিত হয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে একে ওকে জিজ্ঞেস করে ঠিক কবরের সন্ধান করে পৌঁছে দিলেন। পীরের কবর দর্শন করে যখন আবার মেলায় ফিরে আসলাম ততক্ষনে মিষ্টি মেলা প্রায় ভাঙ্গা মেলায় পরিণত হয়েছে।

মেলায় দোকান কম হলেও তাতে গ্রামবাসীদের উৎসাহে কোন ভাঁটা নেই, দেদার বিকোল মিষ্টি, সূর্য মধ্যগগনে ওঠার অনেক আগেই বেশীরভাগ মিষ্টির দোকানীই হাসি মুখে বাড়ীর পথে, আর কি আশ্চর্য, ক্রেতারাই বিক্রেতাদের বলছে সামনের বছর আবার আসার জন্য, ধন্য মিষ্টি মেলা।

পুনশ্চ : খুব উত্তম মানের মিষ্টির আশা করে এই মেলায় না আসাই ভালো, শুধুমাত্র একটু অন্যরকম মেলা দেখার আনন্দ উপভোগ করতে চাইলে খুব ভালো লাগবে। মেলা এক সপ্তাহের বেশী চললেও মিষ্টির বিকিকিনি ওই দিন সকালেই কয়েকঘন্টা। আর হ্যাঁ, ফেরার পথে কৌশিকের গোপালনগরের বাড়ীতে মাসিমার হাতের ছোলার ডাল আর হিংয়ের কচুরী, এক কথায় অসাধারন, ওই কচুরী আর পরিবারের সকলের আন্তরিকতার টানেই আবার গোপালনগর যাওয়ার ইচ্ছা রইল।
Source: doorersathi.blogspot.com

[ngg src=”galleries” ids=”4″ display=”basic_thumbnail” thumbnail_crop=”0″]
গোবরডাঙ্গার মশলা মেলা
ইংরেজদের হাত ধরে প্রথম ঘোড়ার দৌড় শুরু বারাসাত কাছারি মাঠে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

My Cart
Wishlist
Recently Viewed
Compare Products (0 Products)
Compare Product
Compare Product
Compare Product
Compare Product
Categories