হালকা হলুদ রংয়ের বিশাল থামওয়ালা গরাদহীন রাজবাড়ীর সিংহ দরজা দিয়ে মেলার মাঠে প্রবেশ করতেই বিভিন্ন মশলার মিলিত গন্ধ নাকে এসে পৌছালো, গন্ধটা অনেকটা বড়বাজারের মশলা পট্টির মত। নাম গোষ্ঠ বিহার মেলা হলেও বিভিন্ন মশলার বিকিকিনি, এটাই এই মেলার বিশেষত্বঃ, মুখে মুখে এই মেলা তাই মশলা মেলা নামেই পরিচিত, ভারতবর্ষের কথা বলতে পারছিনা কিন্তু আমাদের বাংলায় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এই মেলা অবশ্যই এক অভিনব মেলা। বস্তুত এখনো আমাদের গ্রাম বাংলাতে যে কত বিচিত্র মেলা পার্বন অনুষ্ঠিত হয় তা সার্বিকভাবে অজানাই রয়ে গেছে।
বাংলা ১৪২৫ সালের শেষ দিনে কাজের শেষে বাড়ী না ফিরে বারাসাত স্টেশন থেকে চড়ে বসেছিলাম দিনের শেষ বনগাঁ মুখী ট্রেনে, ইংরাজী মতে তার আধঘন্টা আগেই নতুন দিন শুরু হয়ে গেছে। মাঝ রাতের জনবিরল গোবরডাঙ্গা স্টেশনে নেমে একটু অপেক্ষা করে শুনশান রাস্তা দিয়ে ২ কিলোমিটারের মত হেঁটে মেলা চত্বরে পৌছালাম, রাত তখন ২:৩০। ক্রেতা না হলেও বিক্রেতা বাদে আমরাই প্রথম, সেই সুবাদে অনেকেরই কৌতূহল নিবৃত্ত করার ফাঁকে ফাঁকে আলাপটাও সেরে নেওয়া গেল। রাত ৩ টের পর থেকেই স্বল্প আলোয় পাইকারি ক্রেতারা মোবাইলের আলো জ্বেলে মশলার গুণমান পরীক্ষা আর দরদাম শুরু করে দিলেন, কোন ঝগড়া নেই, রাগারাগি নেই, হাসি মুখে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। যত ভোরের আলো ফুটতে লাগল মেলায় বিক্রেতার সংখ্যাও বাড়তে লাগলো, ভোর ৫টার পর থেকে ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়ে চলাই দায়। মেলার বেশীর ভাগ জায়গাটা জুড়েই পাইকারী বাজার সেখানে বিক্রেতাদের ভীড়, পাইকারী ক্রেতার সংখ্যা খুচরো বাজারের তুলনায় অনেক কম আর এক পাশে খুচরো বাজারে ক্রেতার ভিড়ে বিক্রেতাদের গলদঘর্ম অবস্থা। পাইকারী বাজারে মূলত স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত রাঁধুনি, সর্ষে, হলুদ, কালোজিরে, মুসুরির ডাল বিক্রী হলেও খুচরো বাজারে প্রয়োজনীয় প্রায় সব রকম মশলা, বিভিন্ন রকম ডাল মজুত আর দামও বেশ খানিকটাই কম। বাড়ীর মহিলারাও পাল্লা দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন দরদাম করা বা মশলার গুনমান যাচাইয়ে তারাও কম যান না, মহিলা ক্রেতারাই খুচরো বাজারে সংখ্যা গরিষ্ঠ। আস্ত মশলা কিনে আবার অনেকে সেই মশলা গুঁড়ো করিয়ে নেওয়ার জন্য মেলার মাঠের বিপরীতের গম ভাঙানোর কলে ছুটছেন, সব কিছুরই ব্যবস্থা তৈরী। মেলা মানেই আনন্দের জায়গা, খুশির জায়গা তাই মতান্তর হলেও সবই হচ্ছে হাসি মুখে। মাঝে মাঝে মাইকের ঘোষণা মনে করিয়ে দিচ্ছে বর্তমানে মেলা পরিচালনায় আলাদা কমিটি দায়িত্ব নিলেও এর অতীত জমিদারী আমলের। জমিদারী প্রথার মতই ঘোষণা হচ্ছে মেলায় পাইকারি মশলা বিক্রি করার জন্যে খাজনার কথা, এই বছরের খাজনা ধার্য হয়েছে বস্তা পিছু ১২ টাকা, যার ৬ টাকা দিতে হবে ক্রেতাকে আর ৬ টাকা বিক্রেতাকে। মেলায় তৃতীয় লিঙ্গের খানিকটা উপদ্রব আছে তারা প্রতি বিক্রেতার কাছ থেকে অন্তত বড় এক ধামা মশলা জবরদস্তি সংগ্ৰহ করেন, এটাও কি ঐতিহ্য ? জানা হয়নি।
আপনি যদি মেলার ইতিহাস জানতে আগ্রহী হন তাহলে শুনুন, বাংলায় গোবরডাঙ্গা নামটার মধ্যে একটা নাক সিটকানোর ব্যাপার থাকলেও তিনটি সংস্কৃত শব্দ গো (পৃথিবী) বর (শ্রেষ্ঠ) ডাঙ্গা (স্থান) থেকে গোবরডাঙ্গা এই নামের উৎপত্তি অর্থাৎ পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান, দেশের সর্বাধিক পূজিত চতুষ্পদ প্রাণীটির সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই। প্রাচীন কালে কুশদ্বীপ নামে পরিচিত এই অঞ্চলের পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি এবং দক্ষিণে যমুনা। দুই নদীর জলে সিঞ্চিত উর্বর এই অঞ্চল ১৮ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজদের কাছ থেকে নিলামে কেনেন যশোর নিবাসী খেলারাম মুখোপাধ্যায়, পত্তন করেন গোবরডাঙ্গা জমিদারী, এই খেলারাম মুখোপাধ্যায়েরই একমাত্র পুত্র ছিলেন কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। কথিত যে দীর্ঘদিন ধরে নিঃসন্তান থাকা খেলারাম মুখোপাধ্যায়কে স্বপ্নে দর্শন দেন দেবী প্রসন্নময়ী কালী, দেবীর আশীর্ব্বাদেই তিনি পুত্র সন্তান লাভ করেন, আর তার পর থেকেই গোবরডাঙ্গা জমিদার বাড়ীর সমস্ত পুত্র সন্তানদের নামের সঙ্গে দেবী প্রসন্নময়ীর নামের ‘প্রসন্ন’ যুক্ত করার প্রথা মানা হয়ে আসছে। পুত্র লাভের পর খেলারাম মুখোপাধ্যায় প্রসন্নময়ীর মন্দির নির্মাণ শুরু করান কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি পরলোকগমন করেন, পুত্র কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এই মন্দির নির্মাণের কাজ শেষ করান। ১২২৯ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ, ইংরাজী ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্নময়ী দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, আর তার পরের বছর অর্থাৎ ১২৩০ বঙ্গাব্দ থেকেই মন্দিরের পাশের মাঠে শুরু হয় এই মেলা, সেই হিসাবে ১৪২৫ সালে মেলার বয়স ১৯৭ বছর হয়।
কথিত যে গোবরডাঙার উর্বর মাটিতে সেই সময় ধান, পাট, বিভিন্ন সব্জীর সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম মশলারও চাষ হত। এই মেলায় কৃষকরা যেমন তাদের বিবিধ কৃষিজাত সামগ্রী বিক্রি করার সুযোগ পেত তেমনি জমিদারের পক্ষেও সুবিধা হত বকেয়া খাজনা তাৎক্ষণিক আদায় করা।
এতক্ষন যখন আমার সঙ্গে ইতিহাসের চোরা গলিতে ঘুরে বেড়ালেন মনে মনে হয়ত আপনারও একবার এই মেলায় আসার ইচ্ছে রয়েছে, আপানার সুবিধার জন্য বলি গোবরডাঙ্গা শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখায় ২০তম স্টেশন আর শিয়ালদহ থেকে দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। বনগাঁ লাইনের ভিড়ের কথা মাথায় রাখলে ‘অফিস টাইম’ এড়িয়ে চলা আপনার আর অফিসযাত্রী উভয়ের পক্ষেই শ্রেয়, স্টেশন থেকে টোটো, ভ্যান রিক্সা, মোটর ভ্যান পাওয়া যায়, এখানে আসতে কোন অসুবিধা হবে না। মেলা ১৫ দিন ধরে চালু থাকলেও জমজমাট ব্যতিক্রমী মেলা দেখতে চাইলে ১লা বৈশাখ দুপুরের মধ্যে যাওয়াই শ্রেয়। মেলায় পসরা নিয়ে বসা মানুষদের সঙ্গে আলাপ করার অভিপ্রায় না থাকলে আমার মত মাঝ রাতে না গেলে কোন ক্ষতি নেই। তবে হ্যাঁ শেষ ট্রেনে না গেলে নিশুত রাতে ছোট বেলার মত পথের পাশের আম গাছ থেকে ঝরে পড়া আম কুড়ানোর আনন্দটা অনাস্বাদিতই থেকে যেত।
তথ্য সূত্র : লিপির লেখায় গোবরডাঙ্গা – সম্পাদনা কুমারেশ দাস
Source : doorersathi.blogspot.com
[ngg src=”galleries” ids=”2″ display=”basic_thumbnail” thumbnail_crop=”0″]