যশোর রোড শুধুমাত্র একটি সড়ক নয়—এটি বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক জীবন্ত সাক্ষী। এই মহাসড়কটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের যশোর শহর পর্যন্ত বিস্তৃত, যা দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করেছে। প্রায় ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটির রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস, যা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত নানা ঘটনার সাক্ষী।
যশোর রোডের ইতিহাস: ব্রিটিশ আমল থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত
ব্রিটিশ যুগে নির্মাণ ও গুরুত্ব
যশোর রোডের উৎপত্তি ব্রিটিশ ভারতের সময়ে। ব্রিটিশ সরকার কলকাতা (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী) এবং যশোর (অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা) এর মধ্যে যোগাযোগ সহজ করতে এই সড়কটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে যশোরে সেনানিবাস স্থাপন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়েল এয়ার ফোর্সের জন্য যশোর বিমানবন্দর নির্মাণের ফলে এই রাস্তাটির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
জমিদার কালী পোদ্দারের অবদান
যশোর রোডের নির্মাণকাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নড়াইলের জমিদার কালী পোদ্দারের নাম। কথিত আছে, ১৮৪০ সালে তার মা যশোদাদেবী গঙ্গাস্নানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে, নৌপথে অসুবিধার কারণে কালী পোদ্দার মায়ের জন্য সড়কপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় দুই বছর এবং দুই লক্ষ আটান্ন হাজার টাকা ব্যয়ে ১৮৪২ সালে এই রাস্তাটি সম্পূর্ণ হয়। রাস্তার দু’ধারে তিনি রেইন ট্রি (বৃষ্টি শিরীষ) ও কড়ই গাছ রোপণ করেন, যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোডের ভূমিকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যশোর রোড ছিল লাখো শরণার্থীর জীবনরেখা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে অসংখ্য মানুষ এই পথ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই করুণ দৃশ্য দেখে “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” নামে একটি কবিতা লেখেন, যা পরবর্তীতে বব ডিলানের মতো শিল্পীদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। কবিতায় তিনি লিখেন:
“Millions of souls nineteenseventyone
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan…”
এই সড়ক ধরে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছুটেছিল, অনেকে পথেই মৃত্যুবরণ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য এই রাস্তা হয়ে উঠেছিল মুক্তির পথ।

আধুনিক যুগে যশোর রোড: বাণিজ্য ও সম্প্রসারণ
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যপথ
বর্তমানে যশোর রোড ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ। এই সড়কের মাধ্যমে কলকাতা-ঢাকা, কলকাতা-আগরতলা এবং কলকাতা-খুলনা রুটে আন্তর্জাতিক বাস পরিষেবা চালু রয়েছে। সড়কটির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জাতীয় সড়কের অন্তর্ভুক্ত:
- দমদম থেকে বারাসাত: ১২ নং জাতীয় সড়ক
- বারাসাত থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত: ১১২ নং জাতীয় সড়ক
- বেনাপোল থেকে যশোর: বাংলাদেশের এন৭০৬ জাতীয় মহাসড়ক
সম্প্রসারণ প্রকল্প
বাংলাদেশ অংশ
বাংলাদেশ সরকার যশোর রোডকে চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু রাস্তার পাশের শতাব্দীপ্রাচীন গাছ কাটার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনবিক্ষোভের কারণে প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়। পরে সরকার গাছ রেখেই রাস্তা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেয়।
ভারত অংশ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বারাসত থেকে বনগাঁ (পেট্রাপোল) পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এই প্রকল্পে উড়ালপুল নির্মাণ এবং রেলক্রসিং অপসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
যশোর রোডের পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
শতাব্দীপ্রাচীন গাছের ঐতিহ্য
যশোর রোডের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রেইন ট্রি (Albizia saman) এবং কড়ই গাছ শুধু ছায়াই দেয়নি, এগুলি ইতিহাসের সাক্ষী। ব্রিটিশ আমলে রোপণ করা এই গাছগুলি আজও টিকে আছে, যদিও শহরায়ন ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে কিছু গাছ হারিয়ে গেছে।
সাংস্কৃতিক প্রভাব
যশোর রোড শুধু একটি যাতায়াত পথ নয়—এটি সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পেরও অনুপ্রেরণা। অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা এবং বব ডিলানের গানে এই সড়কটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়াও, স্থানীয় লোকগাথা ও ইতিহাসে যশোর রোডের নাম উল্লেখযোগ্য।

যশোর রোডের ভবিষ্যৎ: সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
যশোর রোডের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এটি সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের স্থানীয়রা চান:
- রাস্তাটির নাম “যশোর রোড” হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হোক (বর্তমানে এটি যশোর-বেনাপোল রোড নামে পরিচিত)।
- সড়কের প্রবেশদ্বারে একটি স্মারক ফলক নির্মাণ করা হোক।
- শতবর্ষী গাছগুলির সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হোক।
ভারতেও এই সড়কের সম্প্রসারণের পাশাপাশি এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
উপসংহার: একটি সড়ক, অসংখ্য গল্প
যশোর রোড কেবল একটি মহাসড়ক নয়—এটি বাংলার ইতিহাস, সংগ্রাম, প্রেম ও স্বপ্নের প্রতীক। ব্রিটিশ আমলের নির্মাণ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, এবং বর্তমানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য—সব কিছুরই সাক্ষী এই সড়ক। এর গাছগুলি, পথের ধুলো, মানুষের পদচিহ্ন—সবই মিলে তৈরি করেছে এক অনবদ্য ইতিহাস। যশোর রোড তাই শুধু যাতায়াতের পথ নয়, এটি বাংলার হৃদয়স্পন্দন।