বারাসাত কালীপূজা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিখ্যাত ও বৃহত্তম কালীপূজা উৎসব। এই কালীপূজা শুধুমাত্র উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতে নয়, সমগ্র বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক আলোর উৎসব ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু ।
বারাসাতের কালীপূজার ইতিহাস অতি প্রাচীন নয়; এই অঞ্চলে কালীপূজার সম্প্রসারণ ঘটে মূলত দেশভাগের সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের মাধ্যমে । দেশভাগের পরে বিভিন্ন সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে উদ্বাস্তুদের বসতি গড়ে ওঠে এবং তাঁদের হাত ধরেই কালীপূজার প্রচলন শুরু হয় বারাসাতে। একাধিক ঐতিহাসিক নথি ও জনমুখে প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, বারাসাতে সংগঠিত বড়ো কালীপূজার সূচনায় বিশিষ্ট অবদান রয়েছে মহাদেব সেন নামে এক স্থানীয় ব্যক্তির। ১৯৫৬ সালে তাঁর উদ্যোগে “শক্তির আরাধনায় রেজিমেন্ট” নামে একটি বড় আয়োজন হয়। এরপর থেকেই বারাসাতে ধারাবাহিক বড় কালীপূজার চল শুরু হয় । এরপর কল্যাণ ভট্টাচার্য-সহ আরও কিছু ব্যক্তির উদ্যোগে বারাসাতের কালীপূজা আরও বিস্তৃত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বারাসাতের পশ্চিমাংশ অর্থাৎ রেল লাইনের পাশের এলাকাতে মূলত বাঙাল উদ্বাস্তু সম্প্রদায় প্রথম বড় করে কালীপূজা শুরু করেন। কয়েকজন তরুণের প্রচেষ্টায় এই পরম্পরা গড়ে ওঠে প্রায় ৬২ বছর আগে ।
কালীপূজার ধরণ ও বৈশিষ্ট্য
বারাসাতের কালীপূজা থিমের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর নতুন নতুন থিমে সাজানো হয় প্যান্ডেল, তৈরি হয় নানা ধরনে আলো ও শিল্পকলা। কলকাতার দুর্গাপূজার মতোই বারাসাতের কালীপূজা থিম, প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জায় সমগ্র রাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব পায় । লক্ষাধিক মানুষ বারাসাতে কালীপূজা উপলক্ষে ভিড় জমান। উদ্ভাবনী থিম যেমন– হ্যারি পটার, বালির উলুন দানু বাটুর মন্দির ইত্যাদি নিয়ে প্যান্ডেল তৈরি হয়, আবার কোথাও দেখা যায় বাংলার লোকশিল্পের ছোঁয়া।
উল্লেখযোগ্য কিছু বিখ্যাত কালীপূজার নাম– বরেরামা (লরি স্ট্যান্ডের বড়মা কালী), রেজিমেন্ট, কে এন সি, পায়োনিয়ার, শুভশ্রী, কল্যাণ সংঘ প্রভৃতি, সন্ধানী,জাগৃতি,তরুছায়া,শতদল, আগুয়ান,ছাত্রদল,নবপল্লী এ্যাসোসিয়েশন,নবপল্লী ব্যায়াম সমিতি।আর নতুনদের মধ্যে রাইজিং স্টারস,আমরা সবাই। প্রতিটি পূজোর আলাদা আলাদা ইতিহাস, অনন্য বৈশিষ্ট্য ও ভক্তি-সংস্কৃতির ছাপ লক্ষণীয়।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
বারাসাত কালীপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি এখানকার মানুষের সাংস্কৃতিক, সমাজিক মিলনের এক বিরাট উপলক্ষ। গোটা শহরনারী, পুরুষ, শিশু—সবাই মেতে ওঠেন এই আলোর উৎসবে। সাম্প্রতিক সময়ে থিম ও প্যান্ডেল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে শিল্পীসত্তার পরিস্ফুটন। ব্যবসা, স্থানীয় ছোট বড়বাজারি, খাদ্যদোকান, হস্তজাত শিল্পের দোকানসহ বারাসাতের অর্থনীতিতেও এই কালীপূজার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে ।
উপসংহার
কলকাতার দুর্গাপূজার মতো, বারাসাতের কালীপূজা আজ এক বৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়েছে—যেখানে আধুনিক কল্পনা, লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক সম্প্রীতি একসাথে মিশে যায়। বাংলাদেশসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষের সমাগম ঘটে এই পূজায়, বারাসাত হয়ে ওঠে আলোর শহর ।
