হৃদয়পুর একটি রেলস্টেশনের নাম – স্বপনকুমার চট্টোপাধ্যায়
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ১৮৩১ সালের তিতুমিরের বারাসাত বিদ্রোহ বা ওয়াহাবি আন্দোলন, ১৮৬২ সালে এবং তার পূর্বে দুদুমিঞার নেতৃত্বে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে ফরাজিদের আন্দোলন, ১৮৫৫-৫৬ সালে সাঁওতাল পরগনায় সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে সাঁওতালদের অভ্যুত্থান, ১৮২৪ এবং ১৮৫৭ সালে ব্যারাকপুর–বারাসাত অঞ্চলে ইংরেজ অধীনস্থ দেশীয় সিপাহিদের বিদ্রোহ, লবণ তৈরির ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের নানা বিধিনিষেধ, ১৮৬০ সালে বারাসাত–নদিয়া অঞ্চলে দিগম্বর ও পীতাম্বর বিশ্বাসের নীলবিদ্রোহ—এই সমস্ত ঘটনাই কোম্পানির শাসন তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে করে দেয়। এই সমস্ত বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ দমনের জন্য ইংরেজ সরকার তখন সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
কিন্তু দেখা গেল, বিদ্রোহ দমনে যে দ্রুত সামরিক তৎপরতার প্রয়োজন, তার অভাব রয়েছে। ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম রেল চলে। তার গতিবেগ সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কর্ণধাররা মনে করেন—ভারতে রেল চললে সৈন্য চলাচল সহজ হবে, বিদ্রোহ দমন আরও তৎপরতার সঙ্গে করা যাবে এবং সামরিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে।
ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা মনে করেন—রেলের মাধ্যমে শিল্পজাত দ্রব্যাদি সহজে ভারতের গ্রামাঞ্চলে রপ্তানি করা যাবে, আবার ভারতের কৃষিজাত দ্রব্য বিশেষত তুলা, চা, তৈলবীজ ইত্যাদি ব্রিটেনে আমদানি করা সহজ হবে। ভারতের গ্রামগুলিতে ব্রিটেনে তৈরি সুতিবস্ত্র বিক্রিও বৃদ্ধি পাবে। ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে প্রায় ১৫ বিলিয়ন পাউন্ড—তখনকার ব্রিটিশ বিনিয়োগের প্রায় অর্ধেক—ভারতে রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়।
১৮৫৩ সালে বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত রেল চলে। ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলি। ১৮৫৭ সালে স্থির হয় যে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করবে। কুষ্টিয়ায় নদীসেতু নির্মাণ করে পূর্ববঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে তা বাতিল হয়। তবে ১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেল চালু হয়। ১৮৮৩ সালে ই. বি. রেলওয়ে ঘুঘুডাঙা (দমদম জংশন) থেকে দত্তপুকুর পর্যন্ত, ১৮৮৪ সালে গোবরডাঙা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করে; ক্রমে তা বনগাঁ এবং খুলনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তখন ঘুঘুডাঙা থেকে বারাসাত পর্যন্ত রেলওয়ে স্টেশনের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম—ঘুঘুডাঙা, গোরাবাজার (দমদম), বিরাটি, মধ্যমগ্রাম ও বারাসাত।
প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা ছিল নগণ্য। ডেলি প্যাসেঞ্জার বা নিত্যযাত্রী প্রায় ছিল না বললেই চলে। জীবিকার প্রয়োজনে বারাসাতের যাঁদের কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল—তাঁরা বাসাবাড়ি, পাইস হোটেল, আত্মীয় বা গ্রাম-সম্বন্ধীয় কারও বাড়িতে কলকাতায় বাস করতেন। মাসে এক-দু’বার বা কোনো ছুটিতে তাঁরা বারাসাতে নিজেদের বাড়িতে ফিরতেন।
১৮৪৬ সালে বারাসাতে গভর্নমেন্ট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। অল্প ইংরেজি জানলেই কলকাতায় সাহেব কুঠিতে সহজে চাকরি পাওয়া যেত। গভর্নমেন্ট স্কুলের প্যারি চরণ সরকার, রামতনু লাহিড়ী, রসময় দত্তের ছাত্ররা এবং তাঁদের উত্তরপুরুষরা যথেষ্ট সাবালক ও চলনসই ইংরেজি জানতেন। ফলে তাঁদের চাকরি পেতে অসুবিধা হতো না। বিশেষত বারাসাত দক্ষিণপাড়ার বাবু বরদাচরণ ব্যানার্জি, মার্টিন বার্ন কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী, তাঁর সুপারিশে কলকাতার মার্টিন বার্ন বা অন্য সাহেব কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া আরও সহজ হয়ে ওঠে।
এরপর থেকে বারাসাতের বাসিন্দাদের আর কলকাতায় থাকার প্রয়োজন রইল না। বারাসাত স্টেশন থেকে সকাল ৮টার ট্রেনে উঠে এবং শিয়ালদহ থেকে সন্ধ্যা ৬টার ট্রেনে ফিরলেই দৈনিক যাতায়াত সম্ভব। সামাজিক ব্যবস্থারও পরিবর্তন এল। চণ্ডীমণ্ডপে বা টোল, মাদ্রাসা বা মক্তবে সংস্কৃত, আরবি-ফারসি জানা পাত্রের চেয়ে ‘ইংরেজি জানা, কলকাতার সাহেব কুঠিতে চাকরিরত কেরানি’-এর কদর বাড়ল। ফলে অল্প ইংরেজি জানা যুবকেরাও চাকরির সন্ধানে উঠে পড়ল। ডেলি প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বাড়তে লাগল। এভাবেই প্রায় ২০ বছর কেটে গিয়ে এলো ১৯০০ সাল।
কিন্তু মধ্যমগ্রাম ও বারাসাত স্টেশনের মধ্যবর্তী দূরত্ব কম ছিল না। এই দুই স্টেশনের রেললাইনের আশেপাশে বহু পাড়া, পল্লী ও গ্রাম। এর বাসিন্দাদের অনেকে জীবিকার প্রয়োজনে নিত্যযাত্রী। হরিহরপুর, উদয়রাজপুর, কুতুলশাহী, নিশ্চিন্তপুর, ইছাপুর প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষ তখন মূলত কৃষিজীবী ও গোপালক। তাঁদের আলু, বেগুন, পটলসহ অন্যান্য তরিতরকারি, দুধ, ছানা, মাখন ইত্যাদি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ভালো দাম পাওয়া প্রয়োজন ছিল।
বারাসাত দক্ষিণপাড়া—একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, সমৃদ্ধ পল্লী—যেখানে মিত্রপাড়া, ঘোষালপাড়া, দক্ষিণপাড়া, রথতলা পাড়া, শীতলাতলা পাড়া, পূর্বপাড়া, শিবের কোটা পাড়া, মুখার্জীপাড়া প্রভৃতি ছিল—এই পাড়াগুলির অফিসযাত্রীদের সংখ্যাও তখন বাড়ছিল। অন্যান্য জীবিকার মানুষ—স্বর্ণকার, ময়রা, ছোট ব্যবসায়ী—যাঁদের প্রায় প্রতিদিন কলকাতায় যেতে হয়, তাদের জন্য মধ্যমগ্রাম বা বারাসাত স্টেশন অনেক দূর। দুই স্টেশনের মাঝামাঝি যদি একটি স্টেশন হয়, তবে যাতায়াত অনেক সহজ হয়।
১৯০০–১৯০৫ সালের মধ্যে হরিহরপুর ও বারাসাত দক্ষিণপাড়ার ডেলিপ্যাসেঞ্জার ভদ্রলোকদের নেতৃত্বে রেললাইন-সংলগ্ন হরিহরপুরে একটি স্টেশন করার দাবি ওঠে। শুরু হয় চিঠিচাপাটি, দরখাস্ত লেখা রেল কোম্পানিকে। অবশেষে রেল কোম্পানি রাজি হয়—কেউ যদি স্টেশনের জন্য বিনা পয়সায় প্রয়োজনীয় জমি দেয়।
হরিহরপুরে বাস করতেন হৃদয়নাথ ঘোষাল। তিনি দক্ষিণপাড়ার জমিদার মোহনলাল মিত্রের কুলপুরোহিত ছিলেন। মোহনলাল মিত্র তখন কলকাতা শ্যামবাজার অঞ্চলে ভদ্রাসন স্থাপন করে সেখানে বসবাস শুরু করেছেন (শ্যামবাজারের ঘড়িঘর ও মোহনলাল মিত্র স্ট্রিট)। হৃদয়নাথ দক্ষিণপাড়ার মিত্রদের ভদ্রাসনে বিভিন্ন বিগ্রহের পূজা করতেন। মাঝেমাঝে তিনি হেঁটে যেতেন শ্যামবাজারের ভদ্রাসনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে। তিনিই ছিলেন মিত্রদের কুলপুরোহিত—দয়নাথ ভট্টাচার্য। তাঁর ঘোষাল পদবি লোপ পায়। তাঁর উত্তরপুরুষেরা হরিহরপুরে ‘ভট্টাচার্য’ নামেই পরিচিত হন।
হৃদয়নাথের অন্যতম উত্তরপুরুষ কালিদাস ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন উদারমনা শিক্ষাবিদ। শিক্ষকতাই ছিল তাঁর পেশা ও নেশা। স্টেশন নির্মাণের জন্য তিনি রেল কোম্পানিকে ১৫ বিঘা জমি বিনামূল্যে প্রদান করেন। পূর্বপুরুষ হৃদয়নাথের নামে গড়ে ওঠে হৃদয়পুর স্টেশন—‘বহুজন হিতায় চ।’
প্রথমে ১৯০৭ সালে “হল্ট স্টেশন” হিসেবে হৃদয়পুরের সূচনা—মাত্র একটি কুঁড়েঘর। স্থানীয় যুবকেরা চিন্তায় পড়ে, স্টেশনটি উঠে যাবে না তো? তাই তাঁরা লোকজনকে টিকিট কাটতে অনুরোধ করতে থাকেন—বিশেষ করে মাসিক টিকিট। অল্পদিনেই স্টেশনটির পরিপূর্ণতা আসে। ১৯১৩ সালে স্টেশনের দক্ষিণ দিকে পাকাবাড়ি নির্মাণ হয়। হৃদয়নাথের স্মরণে হরিহরপুর পরিচিত হয় “হৃদয়পুর” নামে।
কাস্তে-কবি দীনেশ দাস লিখেছিলেন—
“হৃদয়পুরে মোর হৃদয় গিয়েছে চুরি।”

