দক্ষিণপাড়ার সেনপুকুর (শ্যানপুকুর)

দক্ষিণপাড়ার সেনপুকুর (শ্যানপুকুর)

দক্ষিণপাড়ার সেনপুকুর (শ্যানপুকুর)

কলমে: স্বপনকুমার চট্টোপাধ্যায়

বারাসাতের যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুকুরের অস্তিত্ব আজও দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণপাড়ার প্রান্তদেশে রথতলার চিখি, তার কাছাকাছি সেনপুকুর (শ্যানপুকুর), রথতলার জিউবাড়ির কাছে নিমচাঁদের মন্দির পুকুর, বারাসাত ডাকবাংলোর মোড়ে মুঘল যুগ ও কোম্পানির প্রথম যুগে সরকারি চিঠিপত্র বা ডাকযাত্রার প্রয়োজনে ঘোড়াদের পান ও স্নানের জন্য ব্যবহৃত দুল্লিপুকুর। যশোর রোড ধরে এগিয়ে যশোর রোড ও চৌধুরীপাড়ার সংযোগস্থলে জগৎশেঠের বংশধর রামচন্দ্র শেঠ প্রতিষ্ঠিত শেঠপুকুর। বর্তমান চাঁপাডালির মোড় ছাড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক মধু ও মুরলীর পুকুর—মধু ও মুরলী ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন জমিদার। কোম্পানি আমলের প্রথম যুগে কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী ল্যামবার্ট ও তাঁর স্ত্রী হোরা এখানে হাওয়ামহল ও বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন।

এছাড়া আছে হাতিপুকুর—যেখানে কলকাতা আক্রমণকালে নবাব সিরাজদৌল্লার হস্তীবাহিনীর কিছু হাতি রাখা হয়েছিল, এবং একসময় হাতিপুকুর থেকেই বারাসাত–বসিরহাট রেলওয়ের ইঞ্জিনগুলির জল সরবরাহ হতো। বারাসাত নবপল্লীর কাছে আছে কলপুকুর। নীলকর সাহেবদের প্রয়োজনের জন্য খনন করা হয়েছিল বারাসাত রেলওয়ে স্টেশনের কাছে আর একটি নীলপুকুর, যা বর্তমানে পাইওনিয়ার পুকুর। সম্ভবত একসময় এই পুকুরগুলির সুপেয় জলেই বারাসাতবাসীর তৃষ্ণা নিবারণ হতো।

রথতলার কাছাকাছি সেনপুকুর প্রতিষ্ঠিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সেইসময় বারাসাতে কোনো বৈদ্যবংশীয় সেন ছিলেন বলে মনে হয় না। স্বনামধন্য হরিনাথ সেন ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বারাসাতের বাসিন্দা। তাঁর নামে দক্ষিণপাড়ায় একটি বড় রাস্তা আছে। বারাসাত ও মধ্যমগ্রামে তাঁদের বিরাট ভূসম্পত্তি ছিল। তিনি ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর এবং পরবর্তীকালে বারাসাত মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান।

১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস বিন্নি ট্রেভর ‘বারাসাত অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে তোলেন। এই অ্যাসোসিয়েশন প্রাথমিক যুগে পৌরসভার কাজ তদারকি করত। হরিনাথবাবু এই অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সেক্রেটারি এবং ১৮৯৮–১৯০২ চার বছর বারাসাত মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এই সেনবংশীয়রা ছিলেন বাসুকী গোত্রীয় কায়স্থ। যদিও একসময় হরিনাথ সেন বা তাঁর পূর্বপুরুষরা সেনপুকুরের অধিকারী ছিলেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না—ইতিহাস বা লোককথা কোনো উৎসেই তা সমর্থিত নয়, বরং সেনপুকুরের প্রতিষ্ঠা তাঁদের বহু আগেই হয়েছিল।

হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ (রচনাকাল ১৮১৫), পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্নের ‘উদ্ভট সাগর’ (১৯৩৭), তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৫৬) গ্রন্থে শোভাবাজারের প্রবাদপুরুষ নন্দরাম সেনের উল্লেখ আছে। নন্দরামের মৃত্যুকাল ১৭৬৮ হলেও জন্মসাল স্পষ্ট নয়। মনে হয় এই তিনজন লেখকই নন্দরাম সেন এবং ‘ব্ল্যাক জমিদার’ নন্দরামকে একই ব্যক্তি বলে ভুল করেছিলেন।

ব্ল্যাক জমিদার নন্দরামের পদবী জানা যায় না। সপ্তদশ শতাব্দীতে কলকাতা রেসিডেন্সির খাজনা আদায়কারীর পদে নিযুক্ত র‍্যালফ শেলডন তাঁর সহকারী করেন নন্দরামকে। জালজুয়াচুরির দায়ে ১৭৯১ সালে তিনি অপরাধী প্রমাণিত হয়ে জরিমানা দেন। ফলে তাঁর পরিবারের প্রভাব কমে যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে—১৭৬৮ সালে নন্দরাম সেনও যথেষ্ট প্রভাবশালী। উভয় ব্যক্তিকে এক মনে করলে নন্দরামের বয়স ৯৬ হত, যা অস্বাভাবিক। সুতরাং দু’জন আলাদা ব্যক্তি এবং আলাদা সময়ের। লোককথা এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

নন্দরাম সেনের সঙ্গে বারাসাতের সেনপুকুর প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা রেসিডেন্সির দেওয়ান, দক্ষিণরাঢ়ীয় কায়স্থ। তাঁদের আদি বাসস্থান হাওড়ার কোনা ও উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা (দ্বিগঙ্গা/দীর্ঘগঙ্গা)। কলকাতার শোভাবাজারে জঙ্গল কেটে তিনি যে পত্তনি গড়ে তোলেন—সেটিই আজকের নন্দরাম সেন স্ট্রিট ও নন্দরাম লেন। সেইসময় তিনি তাঁর পত্তনিতে কয়েক ঘর ব্রাহ্মণ পরিবার—মুখোপাধ্যায়, চক্রবর্তী ও গোস্বামীদের ভদ্রাসন বসান।

সে যুগে শিবাবলি নামে এক অদ্ভুত ব্রত প্রচলিত ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নানাবিধ খাদ্য রান্না করে রাতে শৃগালকে নিবেদন করা হতো। শোভাবাজার অঞ্চলে শৃগালের অভাব না থাকায় নন্দরামের মাতৃদেবীর ব্রতপালনে অসুবিধা হয়নি। তিনি ‘জলসংক্রান্তি’ নামে আর একটি ব্রতও পালন করতেন, যাতে মাটি, তামা, রূপা, সোনা—এই চার উপাদানে নির্মিত দ্বাদশ কলস জল বারো জন ব্রাহ্মণকে দান করা হত।

নন্দরামের ‘জীবনোপাখ্যান’ গ্রন্থে দেখা যায়, তিনি ভাটপাড়ার গুরুদের অন্যতম শিষ্য ছিলেন—যা সে কালের নিয়মের ব্যতিক্রম।

মায়ের অনুরোধে জলসংক্রান্তি ব্রত আরও নিখুঁত করতে নন্দরাম গুরুবিধান চান। গুরুগণ বলেন—যেখানে জলকষ্ট আছে, এমন দ্বাদশ স্থানে দ্বাদশ জলাশয় স্থাপন করলেই ব্রত সিদ্ধ হবে।

এই উদ্দেশ্যে ডুলি করে নন্দরাম শোভাবাজার থেকে দীর্ঘগঙ্গার দিকে যাত্রা করেন। তখন শোভাবাজার ছিল খানাখন্দে ভরা, কিন্তু কলকাতা থেকে বারাসাত পর্যন্ত ছিল ছায়াঘেরা চলার মতো পথ। সেই পথে বারাসাতে এসে নন্দরাম দেখেন—জলকষ্টে দীনদরিদ্র দুই বৃদ্ধা পরস্পর ঝগড়া করছেন; একজন অন্যজনের কাছে বিশ মালা জল ধার করেছিলেন, মাস কেটে গেলেও শোধ হয়নি। এই জলসংকটে নন্দরাম সমব্যথী হন এবং সেখানেই জলাশয় খননের সিদ্ধান্ত নেন। কৃষ্ণনগরের মহারাজের কাছ থেকে ২২ বিঘা জমির পাট্টা নিয়ে মায়ের দ্বাদশ পুষ্করিণীর প্রথমটি তিনি খনন করেন—এই জলাশয়ই আজকের ‘সেনপুকুর’ বা ‘শ্যানপুকুর’।

শুধু জলাশয় নয়—তিনি এর চার পাশে মন্দির, দেবালয়, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, আম, জাম, কাঁঠাল, বেলসহ বহু ফলের গাছ, গন্ধরাজ, চাঁপা, কামিনী, বকুলসহ ফুলের বাগান, কাছারি বাড়ি, ভদ্রাসন, নিমকমহল ও আনন্দকুঠি নির্মাণ করেন।

রথতলার দুটি শিবমন্দির, সীতারাম জিউ মন্দির, নিমচাঁদ মন্দির ও বাবাঠাকুরের থানের মধ্যে কোনগুলি নন্দরাম নির্মাণ করেছিলেন তা নির্ণয় করা কঠিন। সম্ভবত রথতলার দিঘি দক্ষিণপাড়ার জমিদার মিত্রদের খনন। একটি বড় খাতের মাধ্যমে দিঘির সঙ্গে সেনপুকুরের সংযোগ ছিল। বারাসাতের অদূরে সাইবনা গ্রামে হয় দ্বিতীয় জলাশয়। পরবর্তী চারটির সঠিক খোঁজ পাওয়া যায়নি। সপ্তমটি দীর্ঘগঙ্গায়, অষ্টমটি পুরোহিতের গোপালনগরে, নবম–একাদশটি শোভাবাজারের নিকটে, দ্বাদশটি হিজলিতে খনিত হয়।

‘কলকাতার পুরাকথা’ ও ‘কলকাতার মন্দির স্থাপত্য’ গ্রন্থে দেখা যায়—বর্গী আক্রমণের ভয়ে শোভাবাজারের বহু বর্ধিষ্ণু পরিবার হিজলিতে পালান বলা হলেও ইতিহাসে তার প্রমাণ নেই। সম্ভবত ১৭৫৬ সালে সিরাজদৌল্লার কলকাতা আক্রমণকালে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

নন্দরামের উত্তরপুরুষ জয়ন্তীচন্দ্র জানান—তাঁর সময়ে সেনপুকুর, নিমকবাড়ি, কাছারি বাড়ি প্রভৃতি ভালো অবস্থায় ছিল, কিন্তু নন্দরামের অট্টালিকা ভগ্নদশায় পৌঁছেছিল। বারাসাতে নন্দরামের ভদ্রাসন ‘দেওয়ানবাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। পলাশির যুদ্ধের পর তিনি কলকাতায় ফিরে যান। সেনপুকুরে মাকে নিয়ে জলসংক্রান্তি ব্রত সম্পন্ন করেন। এই উপলক্ষে এক বিরাট রথও নির্মিত হয়—সম্ভবত বারাসাতের প্রথম রথ। পরে জমিদার মিত্রদের রথ নির্মিত হয়।

নন্দরামের মৃত্যুর পর সেনপুকুর ও অন্যান্য সম্পত্তি নিয়ে মামলায় তাঁর উত্তরপুরুষরা অধিকাংশ সম্পত্তি হারান। সম্ভবত এই সময়ে হরিনাথ সেন বা তাঁর পূর্বপুরুষরা সেনপুকুরের অধিকারী হন। উভয় সেনই বাসুকী গোত্রীয় ও দীর্ঘাঙ্গী সম্প্রদায়ের হওয়ায় সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়। পরে দক্ষিণপাড়ার বরদাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মার্টিন বার্ন কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসেবে ধনী হয়ে এই এলাকা সেনবংশের কাছ থেকে কিনে নেন।

বর্তমানে সেনপুকুরের অস্তিত্ব আছে বটে, তবে এর চারপাশে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে।

ছবি: কাল্পনিক

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *