বারাসতের ‘বড়মা’ — ভক্তি, সোনা, রুপো আর এক শহরের হৃদস্পন্দন
বারাসতের ‘বড়মা’ — ভক্তি, সোনা, রুপো আর এক শহরের হৃদস্পন্দন

বারাসতের ‘বড়মা’ — ভক্তি, সোনা, রুপো আর এক শহরের হৃদস্পন্দন

বারাসত মানেই আলোর উৎসব, মানুষের ভিড়, আর কালীপুজোর থিমে থিমে প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই প্রতিযোগিতার ভিড়ে এক নামে মানুষ থেমে যায়, মাথা নোয়ায়, আর চোখে জল আসে — ‘বড়মা’ কালী মন্দির

চাঁপাডালি মোড় থেকে কলোনি মোড়ের মধ্যে অবস্থিত এই মন্দির এখন শুধু এক পুজো নয়, একটি ঐতিহ্য। স্বাধীনতার আগের যুগে স্থানীয় লরি ব্যবসায়ীরা পুজোটি শুরু করেছিলেন। তখন ছিল না কোনো স্থায়ী মন্দির, ছিল কেবলমাত্র এক মনের টান আর অগাধ বিশ্বাস। আজ সেই বিশ্বাসই ৮৪ বছরের ইতিহাস গড়ে তুলেছে — বারাসতের মাটিতে।

বড়মা মানেই বিশাল মূর্তি, যার উচ্চতা প্রায় ২৪ ফুট, মুকুটসহ। আর এই মূর্তির গায়ে থাকে দু’কেজি সোনা ও ১২ কেজি রুপোর অলঙ্কার। প্রতি বছর এই সব অলঙ্কার ব্যাংকের লকার থেকে বের করে পলিশ করা হয়, আর পুজোর প্রাক্কালে পরানো হয় দেবীমূর্তিকে। সেই মুহূর্তটি যেন এক শহরের সামগ্রিক স্পন্দনের অংশ — তা দেখা মানেই অনুভব করা এক আশ্চর্য আবেগ।

পুজোর সময় বড়মার মন্দির চত্বর উপচে পড়ে ভক্তদের ভিড়ে। সূর্যোদয় থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ধূপ, দীপ, আর ‘জয় মা’ ধ্বনিতে মুখর থাকে গোটা এলাকা। কেউ কর্মশেষে প্রণাম করতে আসেন, কেউ বা শুধুই চোখে দেবী দর্শনের তৃষ্ণা নিয়ে।

বিশেষ আকর্ষণ হল দণ্ডী কাটা। শত শত মানুষ দূরদূরান্ত থেকে দণ্ডী কেটে এসে মা-র চরণে অঞ্জলি দেন। কারও মানত পূরণে বুকের রক্ত অর্পণের দৃশ্যও এক অদ্ভুত ভক্তির প্রতীক হয়ে থাকে।

আর সবচেয়ে বড় কথা — এখানে কখনও কোনো চাঁদা দাবি করা হয় না। সব কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা ও ভক্তি থেকে উৎসারিত। মানুষ স্বেচ্ছায় যা পারেন, তাই নিবেদন করেন বড়মাকে। পুজোর পরদিন হয় নরনারায়ণ সেবা, যা বড়মার আরেকটি মানবিক দিক তুলে ধরে।

গত কয়েক বছরে একবার চুরির ঘটনার কারণে শহর কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু দ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে মন্দির কর্তৃপক্ষ ফের সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে। সম্পাদক সুব্রত চন্দ্র যেমন বলেছেন, “বড়মা শুধু বারাসতের নয়, গোটা জেলার আবেগ।”

প্রতি বছর এই সময় বারাসতের আকাশে যেমন আলোয় ভরে ওঠে, তেমনি মাটিতে ভরে ওঠে এক অনির্বচনীয় ভক্তি। বড়মা যেন সেই ঐক্যের মূর্তি, যিনি ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সৃষ্টি করেছেন এক বিশুদ্ধ মানবিক সম্পর্ক — মানুষ আর মায়ের।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *