বারাসত রামকৃষ্ণ মঠ – শিবানন্দ ধাম

রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ স্বামী শিবানন্দ মহারাজ বারাসতের যে স্থানে জন্মেছিলেন (জন্ম ১৬ডিসেম্বর ১৮৫৪), দেড়শতাধিক বছর আগে সে জায়গাটি ছিল রাণী রাসমণির কুঠিবাড়ি। শিবানন্দ মহারাজের পিতা রামকানাই ঘােষাল ছিলেন বারাসত কোর্টের মােক্তার, রাণী রাসমণির আইনী পরামর্শদাতা। তিনি এই কুঠিবাড়িতে সপরিবারে বসবাস করতেন। তিনি গৃহস্থ হলেও কুঠিবাড়িতে তন্ত্রমতে পঞ্চমুণ্ডীর আসনে নিয়মিত উপাসনা করতেন।

বারাসতের এই কুঠিবাড়িতে স্বামী শিবানন্দ মহারাজ ভূমিষ্ঠ হন। তারকেশ্বরের কৃপায় জন্ম হয় বলে রামকানাই পুত্রের নাম রেখেছিলেন তারকনাথ। ১৯৩৪ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী শিবানন্দজী সাধনােচিত ধামে প্রস্থান করেন।

স্বামী শিবানন্দের শিষ্য ভবতারণ মহারাজ রামকৃষ্ণদেবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াতেন এবং স্থায়ী চিহ্ন রাখবার জন্য ওই সব জায়গায় ফলক বসাতেন। তিনি হাওড়ায় থাকলেও প্রতিবছর মহাপুরুষ মহারাজের জন্মদিন উপলক্ষে বারাসতে এসে অনুষ্ঠান করতেন। মহাপুরুষ মহারাজের এই উৎসাহী শিষ্য, গুরুর জন্মভিটায়। একটি মঠ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং ভক্ত শিষ্যদের সহায়তায় কুঠিবাড়ির তৎকালীন মালিক স্বামী শিবানন্দের ভাইপাে অতুলকৃষ্ণ ঘােষালের কাছ থেকে যােলাে হাজার টাকা দিয়ে কুঠিবাড়ির জীর্ণ গৃহাদি ও জমিসহ তিরিশ কাঠা জমি ক্রয় করেন। পরবর্তীকালে আশ্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে আরও জমি ক্রয় করা হয়। ১৯৫৪ সালে শিবানন্দ ধামে প্রথম বাৎসরিক উৎসব শুরু হয় মহাপুরুষ মহারাজের হাওড়া ও কলকাতার ভক্ত কেদার মজুমদার, উপেন দাস, শিবদাস কুণ্ডু , অজিত মুনসি প্রমুখদের উদ্যোগে। সারদাদেবীর অন্যতম শিষ্য দেবেন মহারাজ (স্বামী যােগাত্মানন্দ) মহাপুরুষ মহারাজের পুণ্য জন্মভূমিতে মঠ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেন। মন্দিরের চূড়ার নক্সা তিনি নিজের হাতে করেন। শুভকাজ শুরু হয় ১৯৫৮ সালের ২১শে জুন। মন্দির নির্মাণের কাজে সহায়তা করেন প্রসিদ্ধ হােমিওপ্যাথি ঔষধ প্রস্তুকারক মহেশ ভট্টাচার্যের সুযােগ্য পুত্র হেরম্ব ভট্টচার্য, অরুণ চৌধুরী, মনােরঞ্জন সরকার, হীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জাস্টিস বি.কে.গুহ, স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক আশু দে প্রমুখ সুধীজন। ১৯৫৮ সাল থেকে মঠে দুর্গাপূজা ও কালীপূজা শুরু হয়। মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শাস্ত্রবিধিমতে সুসম্পন্ন হয় জগদগুরু শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব তিথি ১৯৬১ সালের বৈশাখী শুক্লা পঞ্চমীতে। মঠের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন স্বামী বিশুদ্ধানন্দজী। স্বামী ভূতেশানন্দজী ওইদিন চণ্ডীপাঠ করেছিলেন। মঠে রামকৃষ্ণদেবের পট স্থাপন করেছিলেন মহাপুরুষ মহারাজের সেবক স্বামী কৈলাসানন্দজী। ১৯৬১ সালের পুণ্যতিথিতে মন্দির প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে মন্দির পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়।

আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় দু’জন বেতনভােগী কর্মী ছিলেন; রান্নার জন্য গােপালঠাকুর এবং কায়িক পরিশ্রমের জন্য সােনালাল। আশ্রমবাসী ছিলেন দ’জন রাসমােহন ভট্টাচার্য ও পশুপতি মুখােপাধ্যায়। দৈনিক কাজকর্ম দেখাশােনার দায়িত্বে ছিলেন ধীরেন্দ্র চক্রবর্তী।
তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, শ্রীমা সারদাদেবীর কৃপাধন্য বহু ভক্ত ও সাধু এই আশ্রমে আসতেন, কাজকর্ম করতেন। এই আশ্রমে এসে দেখাশােনা করতেন রহড়ার স্বামী পূর্ণানন্দজী, গৌহাটির পশুপতি মহারাজ (স্বামী প্রণমাত্মানন্দজী) ছাড়াও কানু মহারাজ, সদাশিবানন্দজী, স্বামী অসীতানন্দজী এবং মহাপুরুষ মহারাজের সেবক স্বামী অপূর্বানন্দ। তিনি কয়েকটি মূল্যবান বই লিখেছিলেন এবং আশ্রমের আয়ের একটা উৎস ছিল এই বই বিক্রির টাকা।

এই শক্তিপীঠ ও শিবক্ষেত্রে রামকৃষ্ণদেবের মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭৯ সালের ৮ই মে। মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন কলকাতার বিখ্যাত ভাস্কর জিপাল। প্রতিষ্ঠার দিন মন্দির প্রাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন পূজ্যপাদ স্বামী বীরেশ্বরানন্দ, স্বামী অভয়ানন্দ, স্বামী হিরন্ময়ানন্দ, স্বামী লােকেশ্বরানন্দ। পূজা-হােমযজ্ঞাদির দায়িত্বে ছিলেন স্বামী সুলভানন্দ ও স্বামী হিতানন্দ।

Image courtesy: https://belurmath.org/ramakrishna-math-barasat-kolkata/

বারাসত মঠ খাতাকলমে বেলুড় মঠ কর্তৃক অধিগৃহীত হয় ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে, তবে আনুষ্ঠনিকভাবে অধিগ্রহণ করা হয় ১৯৮৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৫ সালের ২৩শে এপ্রিল মঠে উৎসব হয়। ওই উৎসবে ভাষণ দেন স্বামী ভূতেশানন্দ ও স্বামী গহনানন্দ। ১৯৮৫ সাল থেকেই বারাসত মঠে দীক্ষাদান ব্যবস্তা চালু হয়। বেলুড় মঠের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী গম্ভীরানন্দ ভক্তদের দীক্ষা প্রদান সুচনা করেন।
বেলুড় মঠ কর্তৃক বারাসত আশ্রম অধিগ্রহণ করার পর ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বারাসত রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ পদ অলঙ্কৃত করেন প্রথম দুলাল মহারাজ (স্বামী পুরুষানন্দ), এই মঠে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন সুনীল মহারাজ (স্বামী পুরাণানন্দ) ও মহাদেব মহারাজ (স্বামী সগুণানন্দ)। তারপর নৃপেন মহারাজ (স্বামী মহেশানন্দ)। পরে সুকুমার মহারাজ ও ঋষীকেশ মহারাজ (স্বামী ধর্মদানন্দ ও স্বামী শ্রীনিবাসানন্দ)।

তথ্য স্বীকার : তথ্যগুলি মাধুকরী করেছি ডাঃ হর্ষবর্ধন ঘােষের বারাসাত রামকৃষ্ণ মঠ ও শিবানন্দ ধাম প্রবন্ধ থেকে। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ মঠ, বারাসাত কর্তৃক প্রকাশিত স্বামী শিবানন্দজী মহারাজের আবির্ভাবের ১৫০ বছর পূর্তিতে।।

Source:
বই: ইতিহাসের বারাসাত
লেখক: শম্ভুনাথ ঘোষ
প্রকাশক: বারাসাত সংস্কৃতি পরিষদ
সভাপতি: বিশ্বনাথ ঘোষ

# ধন্যবাদ অয়ন মজুমদার (অয়ন দা) কে, এই বইটি দেওয়ার জন্য।

বারাসাতের হাতিপুকুর আজ সিরাজ উদ্যান
বারাসাতের নানা কথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

My Cart
Wishlist
Recently Viewed
Compare Products (0 Products)
Compare Product
Compare Product
Compare Product
Compare Product
Categories