Source: bongodorshon.com
সিটের গদি পোকায় কাটা, লোহার গায়ে মরচে ধরা, নীল-হলুদ রঙের ছাপোষা একটি বাস। কিন্তু তাকে ঘিরেই ত্রস্ত বারসাত। জনৈক এক ভদ্রলোক সেবার স্টপেজ অবধি পৌঁছতে পারেননি, তার আগেই এসে পড়ে বাস। অগত্যা হাত দেখান ভদ্রলোক। কন্ডাকটার থেকে বাস চালক সকলেরই দৃষ্টিগোচর হয় সে। কিন্তু বাস থামে না। সাঁ-সাঁ বেগে ছুটে গিয়ে বাস থামে নির্দিষ্ট স্টপেজেই। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে গিয়ে ‘রেলা’। বাসের পোষাকি নাম L238। আর ছদ্মনাম ‘দা ফাস্ট এন্ড দা ফিউরিয়াস।’
বারাসাত থেকে হাওড়াগামী এই বাস যেন রোহিত শর্মার ঝোড়ো ইনিংস। আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও একের পর এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়া। ঝক্কি থাকলেও প্রাণহানির ভয় নেই। আছে শুধু নিজের হৃৎস্পন্দনের তীব্রতার অনুভব। যারা বাসে চড়েছেন তারা জানেন যে, একান্ত নাস্তিক মানুষও L238 এর পাল্লায় পড়ে ভগবানকে বার কয়েক ডেকে ফেলে। তবে, লাগামহীন স্পিড এবং বেপরোয়া ওভারটেকের পেছনে লুকিয়ে আছে নামের এক জাদু-ইতিহাস। সে জাদু বারাসাতে রাজ করছে ১৯৮৬ থেকে। অন্যান্য লোকাল বাসের থেকে ভাড়া চোখ বুজে বেশি। তবু, শো হাউসফুল। না, আরামদায়ক অভিজ্ঞতার জন্য নয় মোটেও। বাসে তো পা রাখার সামান্য জায়গাই পাওয়া যায় না অধিকাংশ সময়। তবুও, এই গাড়িতেই ওঠা চাই সব্বার।
L238 এর বারাসাতের ডন হয়ে ওঠার পেছনে একটি জিনিসের অবিস্মরণীয় ভূমিকা। তা একটি অক্ষর- ‘L’। যার অর্থ LIMITED STOPPAGE। L238-ই প্রথম বেসরকারি বাস, যার ভাগ্যে ‘L’-এর মুকুট জুটেছিল। ফলে, তার কাছে ঐতিহ্যই শেষ কথা। তার কাছে স্টিয়ারিং-এর ইতিহাসই একমাত্র সত্য। নামকরণের সার্থকতা রক্ষার জন্য L238 পারে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বিপদের মুখোমুখি হতে।
হাওড়ার ট্রেনযাত্রীদের কোনওদিনও ডোবায়নি এই বাস। তাই, এমন অনেকে আছেন, যাঁরা অনায়াসে ট্রেনে করে বিধাননগর নামতে পারেন। কিন্তু এই বাসেই উল্টোডাঙা যান রোজ। অফিস টাইমেও। এ তাঁদের আঁতের বাস যাকে বলে। রীতিমতো অধিকারবোধ রয়েছে তাঁদের L238-কে নিয়ে।
বারাসাত সাক্ষী থেকে অনেক যুদ্ধের। রাজায় রাজায় যুদ্ধ, ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধকে সাক্ষী করেছে বারাসাত। তবে, আরও একটি অলিখিত যুদ্ধ বারাসাতের উপর দিয়ে বয়ে যেত রোজ। তা বাসে-বাসে গতি-যুদ্ধ। একে অপরকে ওভারটেক করে গতির পারদ আকাশ ছুঁয়ে এক রোমহর্ষক রেষারেষি। L238-এর সঙ্গে 225-এর রেষারেষি সবচাইতে বিখ্যাত ছিল একটা সময়। বনগা-খান্না রুটের 225-এর সঙ্গে L238-এর রেষারেষি নিয়ে যশোর রোডের শয়ে শয়ে চা দোকান মশগুল থাকত। বর্তমানে, 225 রুটের বাসটাই আর নেই। তাই নেই রেষারেষিও। কল্যাণী এক্সপ্রেস নামের একটা সাদা বাসও মাঝেমাঝে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিত L238কে।
L238 বারাসাত বাসট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা আর পাঁচটা বাসের চেয়ে আলাদা। বর্তমানে ৪৩টি বাস চলে এই রুটে। L238-এর ড্রাইভারদের আলাদা পরীক্ষা দিতে হয় রীতিমতো। তাইতো এখনও ভোর চারটের সময়, সকল বাস যখন ঘুমে আচ্ছন্ন তখন বারাসাত থেকে রওনা দেয় L238। তবে শুধুমাত্র L238 নয়, বারাসাতে রয়েছে এমন অসংখ্য বাস, যাদেরকেও ঘিরে রয়েছে অগুন্তি গল্প। সব গল্প একেবারে পেড়ে ফেলা সম্ভব নয়। তবে, 79B বাসটির গল্পও দু-এক কথায় পেড়ে ফেলা যাক।
79B বারাসাতের প্রথম বাস। ১৯৪০ সালে প্রথম চলতে শুরু করলো 79B; রুট ছিল বারাসাত থেকে শ্যামবাজার, শিয়ালদা হয়ে বাবুঘাট। 79 রুটে ছিল আরো তিনটি গাড়ি। 79(শ্যামবাজার থেকে ইটিন্ডাঘাট), 79A( বারাসাত থেকে বাদুড়িয়া) এবং 79C(শ্যামবাজার থেকে বসিরহাট হয়ে হাসনাবাদ)। 79B ছাড়া বাকি সকল বাস আজ অবলুপ্ত। বাসেদের এই হারিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র রাস্তা খারাপের জন্যই নয়; অর্থনৈতিক মন্দা, পেট্রোল-ডিজেলের দামবৃদ্ধির ফলেও। লোকমুখে জানা যায় স্বদেশি বিপ্লবী বারীন ঘোষের এই রুটে গাড়ি ছিল। 79B শান্ত, সৌম্য। বেপরোয়া ভাবে তাকে কখনো চলতে দেখেনি কেউ। হয়তো প্রবীণ বলেই এই সংযম। বারাসাতের বাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম ভাড়া নেয় এই 79B। তার চোরা কারণ অবশ্য ব্রিটিশ আমলের কোলকাতা বেলতলা পার্মিট। একারণেই হয়তো অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়ছে 79B। তার উপর পেট্রোল-ডিজেলের নিত্যনৈমিত্তিক মূল্য-বৃদ্ধি একেবারে ধ্বংস করে দেবে না তো এই রুটের ৩৩টি গাড়িকে?
বাসের মতো বাস-ডিপোর ইতিহাসও তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। বারাসাতের এই বাস-ডিপো একসময় নাকি ছিল ফাঁসি দেওয়ার জায়গা। ব্রিটিশ আমলে অনেক বিদ্রোহী, স্বদেশীদের ফাঁসি হয়েছে এখানে। তারপর, ফাঁসির মঞ্চ উঠিয়ে দেওয়া হলে এখানে পরে তৈরি হল বাস ডিপো।
একদিকে L238-এর রুদ্ধশ্বাস গতি, অন্যদিকে 79B এর চাঞ্চল্যহীনতা- এই দুইকেই নিয়ে রোজ এগিয়ে যাচ্ছে বারাসাত। যাত্রীরা গল্প করতে করতে রোজ পৌঁছে যায় গন্তব্যে। তারা কি জানে যে গল্পের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে বাসেদের নিজস্ব গল্প?
Source: bongodorshon.com