দুই বাংলার হৃদয়ের গল্প ‘হৃদয়পুরের’ নামকরণ
Source: bongodorshon.com
সে কি জানিত না যত বড়ো রাজধানী/ তত বিখ্যাত নয় এ – হৃদয়পুর’ – Hridaypur. ‘আনন্দ ভৈরবী’-তে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যে হৃদয়পুরের কথা বললেন, তা কি বহু ক্রোশ হেঁটে পৌঁছে গেল সুদূরদূ উত্তর-চব্বিশ পরগণার বারাসাতে? প্রশ্ন উঠতে পারে, হৃদয়পুর কোথায়? বারাসাত ও মধ্যমগ্রাম স্টেশনের মধ্যবর্তী এক স্টেশন হৃদয়পুর। মাঝে পাতা দুটি রেললাইনআপ ও ডাউন। প্রতিদিন হৃদয়পুরকে ছুঁয়ে যাতায়াত করে অসংখ্য মানুষ-বোঝাই ট্রেন। তবে, হৃদয়পুর শুধুএকটি স্টেশন নয়; তিনটে ওয়ার্ডে ঘেরা বারাসাত নগরীর এক জনপদও বটে।
বিখ্যাত না হলেও ‘হৃদয়পুরের’ একটা গল্প আছে। সে গল্প কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে, তা জটিল অঙ্কের বীজগাণিতিক সমাধানকে পরোয়া করে না। তার সত্যতা হৃদয়ের লেনদেনেই। বারাসাতের একটি জনপদ হৃদয়পুর। লোকশ্রুতিতে বারাসাতের নানা ইতিহাস ঘেঁটেঘেঁ জানা যায়, আরবি শব্দ ‘বারাসাত’-এর অর্থ ‘র্থপথের শোভা’। ওয়ারেন হেস্টিংস নাকি পথের দুই পাশে সারি বেঁধেবেঁ রোপণ করেছিলেন অসংখ্য গাছ। সেই থেকেই এ নামকরণ। আবার এও শোনা যায়, হেস্টিংসকে খুশি করার জন্য রামচন্দ্র জগৎ শেঠ বারাসাত নগরের কেন্দ্রে স্থাপন করেন ‘শেঠপুকুর’। ‘বারোশেঠ’ এর অপভ্রংশ রূপ পরবর্তীতে হয়ে ওঠে ‘বারাসাত’। নামকরণের এই গোলকধাঁধা ধাঁ য় আরেকটি তথ্যও সজোরে নিজের সত্যতা জাহির করে। তা হল, ফার্সি শর্সি ব্দ ‘বার’ অর্থা ৎর্থা , জনপদ। ‘সাত’টি ‘বার’(জনপদ) নিয়ে গড়ে ওঠা এই মফস্বলের নাম তাই বারাসাত। এই সাতটি জনপদের মধ্যে ছিল- ‘শ্রীধরপুর’, ‘হৃদয়পুর’, ‘বনমালিপুর’, ‘প্রসাদপুর’, ‘চন্ননপুর’ ও ‘নিশ্চিন্দপুর’-এর নাম। বারসাতের মাটি খুঁড়েখুঁ তার নামকরণের শিকড় খোঁজা খোঁ র পাশাপাশি উঠে আসে একটা শব্দবন্ধ, একটা জনপদ- হৃদয়পুর। এমন সুন্দর স্নিগ্ধ নাম যার, তার নামের পিছনের রহস্য কী?
এমনিতে বারাসাত আগে খুব যে জনবহুল ছিল, তা নয়। প্লেগ, ম্যালেরিয়ার মহামারি তখন বিষের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বারাসাতে। মানুষ ছিল কম, মশা-মাছি বেশি। দেশভাগের পরপরই উদ্বাস্ত স্রোতে আছাড় খেয়ে মানুষ এসে পড়তে থাকে বারাসাতে, হৃদয়পুরে। বাংলাদেশের আন্তর্জা তিক খ্যাতি সম্পন্ন চিত্র পরিচালক তানভির মোকাম্মেলের ‘দেশভাগ’ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র ‘সীমান্তরেখা’র এক দৃশ্যে দেখা যায় হৃদয়পুরে উঠে আসা এক রিফিউজির আত্মকথা। এত জায়গা থাকতে তিনি কেন হৃদয়পুরেই আসতে গেলেন?- উত্তরে ভদ্রলোক জানান- ‘শুনেছিলাম, হৃদয়পুরের মানুষেরা হৃদয়বান হন।’ এত সহজে বলে দেওয়া উত্তর; কিন্তু কী গভীর! এ কারণেই কি জায়গার নাম হৃদয়পুর? এই জনপদের নামকরণই কি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রিফিউজিদের ভরসা জুগিজু য়েছিল? যেখানে শোনা যায় বিজয়গড়ে রিফিউজিদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল, সেখানে হৃদয়পুরে এরকম কোনো কঠিন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়নি ছিন্নমূল মানুষদের। তা কি মাঠের পর মাঠ নিছক ফাঁকা ফাঁ জায়গার কারণে? নাকি, হৃদয়পুরের ‘হৃদয়’-এর কারণে?
হৃদয়পুরের নামের পেছনে পাওয়া যায় হৃদয় নামক জনৈক ব্যক্তির কাহিনিও। তার নাকি প্রচুর বাগানবাড়ি ছিল- যদিও তা বর্তমা র্ত নে নিশ্চিহ্ন। অনেকে মনে করেন, তার নাম থেকেই অঞ্চলের নাম ‘হৃদয়পুর’। কে জানে কেন, নামকরণের এত সহজ উৎস মেনে নিতে মন চায় না। তাই, হৃদয়পুর নামের উৎস হিসেবে মানুষ বেছে নিয়েছে ‘হৃদয়’-এর অস্তিত্বটুকুই। জনৈক ব্যক্তির নাম হিসেবে হৃদয় নয়, ওপার বাংলা থেকে আসা শিকড়হীন মানুষগুলোকে আপন করে নেওয়া একটা অঞ্চলের মানুষের ‘হৃদয়।’ হৃদয়পুরের জটিলতার খেলা এই অঞ্চলের নামকরণের মিথকে অন্তত
হারাতে পারেনি।
হয়ত সত্যিই ‘তত বিখ্যাত’ নয়, তবু ‘রাজধানী’র উপকণ্ঠে এই আটপৌরে ইতিহাস নিয়েই আজও বিছিয়ে রয়েছে হৃদয়পুর।
Source: bongodorshon.com