টাকি রোড, কিছু অজানা কথা

লেখকঃ অরিন্দম ঘোষ

বারাসাত চাঁপাডালির মোড় থেকে হাসনাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ৫৫-৬০ কিমি রাস্তাটাকে আমরা টাকি রোড বলে জানি । প্রশ্ন জাগে না এতো জায়গার ওপর দিয়ে যাও য়া সত্বেও রাস্তাটার নাম টাকি রোড কেন ? কারন টাকির জমিদার কালীনাথ মুন্সী নিজব্যয়ে সম্পূর্ণ রাস্তাটা তৈরী করেছিলেন ১৮৩০-৪০ এর মধ্যবর্তী কালপর্বে। কান পাতলে টাকির বয়স্কদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় কালীনাথ তার মায়ের আদেশে রাস্তাটা তৈরী করেছিলেন, তার মা গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে পুণ্যলাভের ইচ্ছা পোষণ করতেন। কালীনাথ তার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে অর্থাত্ মাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই রাস্তা নির্মাণের প্রয়োজন অনুভব করেন, শুরুতেই বলা ভালো এর পুরোটাই জনশ্রুতি , গল্পটার কোন তথ্যগত ভিত্তি নেই।

 

কালীনাথের মা ছিলেন ব্রজেশ্বরী দেবী । তার সাথে কালীনাথের পিতা শ্রীনাথ মুন্সীর বিয়ে হয়েছিল ১৭৮৫ সাল নাগাদ, অর্থাত্ তার জন্ম ১৭৭৫ সালের আশেপাশে, কারণ সমগ্র বাংলায় তখন বাল্যবিবাহের যথেষ্ট প্রচলন আছে, টাকিতে এর মাত্রা ছিল আরও বেশী। টাকি রোড নির্মাণের সময় তার বয়স কমবেশী ৬০। তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে না একজন ষাটোর্দ্ধ বয়সী বৃদ্ধাকে কেন জলপথে না নিয়ে গিয়ে স্থলপথে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হল ? সেই সময় ইচ্ছামতী নদী মাধ্যমে কলকতা পৌঁছোতে লাগতো ৮-১০ ঘন্টা , কালীনাথের একটা বত্রিশ দাঁড়ের বজরাও ছিল যা প্রায়ই দক্ষিণ বাড়ির ঘাটে বাঁধা থাকত, অন্যদিকে একই সময় স্থলপথের একমাত্র বাহন ছিল নরযান যা কিছুটা পালকি ও বাঁশের দোলার সমন্বিত রূপ। যার মাধ্যমে কলকাতা পৌঁছতে কমপক্ষে এক দু দিন লাগতো। উপরের গল্প যে একেবারেই গুজব তা প্রমাণিত আর একটা তথ্য দিলে সেযুগে মেয়েদের কলকাতা যাওয়ার অনুমোদন টাকির সমাজ দেয় নি , যেকারণে কালীনাথের ঠাকুরদা রামকান্ত মুন্সী তার স্ত্রী পদ্মমুখীকে কখনও কলকাতায় নিয়ে যান নি।

 

টাকি রোড নির্মিত হয় পুরোপুরি ব্যবসায়িক কারণে । টাকির পার্শ্ববর্তী সোলাদানায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবনগোলা ছিল । এই লবণবানিজ্যকে সহজসাধ্য করে তুলতে কোম্পনীর তরফ থেকেই এই রাস্তা নির্মাণের কথা ভাবা হয়, কিন্তু এতো বড় রাস্তা তৈরীর টাকা কোম্পানির ছিল না , এজন্য গবর্মেন্টের তরফ থেকে অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার ম্যজিস্ট্রেট সাতক্ষীরা, টাকি প্রভৃতি অঞ্চলের জমিদারদের থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেন । এই অর্থ সংকট মেটাতে এগিয়ে আসেন কালীনাথ মুন্সী, তিনি সমগ্র রাস্তাটি নিজব্যয়ে তৈরীর দায়িত্ব নেন এবং এক লক্ষ টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। সেযুগে যখন কোম্পনির খুব উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মাস মাহিনা ছিল ৫ টাকা তখন কালীনাথ হাজরি ও মাটি বাবদ প্রতি ঝুড়ি একটাকা দরে কেনেন , সংবাদ প্রভাকর , সমাচার দর্পণ , Friend of India সমস্ত পত্রিকাতেই কালীনাথের নাম সমস্বরে উচ্চারিত। কালীনাথের এই সুকীর্তী টাকি এলাকার বৈষ্ণবদের দ্বারা এভাবে গীত হতো –

“ধর্মাবতার এখন বাবু কালীনাথ
নতুন রাস্তা বাঁধিয়ে দিলেন সোলাদানা বারাসাত”

সূত্র:

 

ইতিহাসের আলোকে বারাসাত
হৃদয়পুর | Hridaypur

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

My Cart
Wishlist
Recently Viewed
Compare Products (0 Products)
Compare Product
Compare Product
Compare Product
Compare Product
Categories