লেখকঃ সৌরভ বারুই
(লেখক বারাসাত কলেজের সান্মানিক স্নাতক ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যোগাযোগঃ ৮২৮২৯২৪৪৫৪)
বারাসাত আজ একটি জনবহুল শহর, যা আজ উত্তর ২৪ পরগণা জেলার প্রধান শহর রূপে চিহ্নিত, কালের বিবর্তনে যেখানে তৈরি হয়েছে কোর্ট-কাছারি, খেলার স্টেডিয়াম, গড়ে উঠেছে বড়ো বড়ো শপিং মল, আজ বারাসাতে ট্রেন, বাস মাধ্যমে যতায়াযাতের সুলভ ব্যাবস্থা আছে। কিন্তু একটা সময় এই বারাসাত ছিল সুন্দর বনের অন্তর্ভুক্ত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল, ছিল ঘন বন, বাঘ-সিংহ বিচরণ করতো এই বারাসাত অঞ্চলে । এই বারাসাতে প্রবাহমান “সুবর্নবতী”, “লাবন্যবাতী”, “দেবগঙ্গা” নামে তিনটি নদী যা আজ অতীতের গৌরব হারিয়ে ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে ধাবমান । “সুবর্নবতী” বা “সুটী” সুদূর অতীতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হত, যতায়াযাত করত বড় বড় বাণিজ্যিক তরী । চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যিক যাত্রার পথ হিসাবে এই নদীকেই উল্লেখ করা হয়েছে । এই নদীর তীরে মাটিয়াঘাটা, জগদিঘাটা প্রভৃতি অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল রাজা প্রতাপাদিত্যের বিখ্যাত নৌঘাঁটি । “লাবন্যবতী” নদীটি আজ “নোয়াই” নামে তার করুণ অস্তিত্ব বজায় রেখেছে । “দেবগঙ্গা” নদীটি “দেগঙ্গা” নামক জনপদে নদী-বন্দরের বিষাদময় স্মৃতি হিসাবে বিরাজমান, এর প্রশংসা গৃহীত হয়েছে ভুতত্ববিদ টলেমি ও পিল্লীর কণ্ঠে । টলেমি একে “গঙ্গারিড” বলে সন্মান জানিয়েছেন । বারাসাতের ইতিহাসের সুবর্নময় গৌরব রাজা চন্দ্রকেতুর “চন্দ্রকেতুগড়” –এর খনা মিহিরের ঢিবির থেকে দু- কিলোমিটার উত্তরে পদ্মা (বাংলাদেশের পদ্মা নয়) তার বুক চওড়া করে আজও বিদ্যমান । অন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই প্রাচীন নগরীর প্রাণশক্তি ছিলো পদ্মা ।
বিভিন্ন সময়ে বারাসাতে আবিষ্কৃত হয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন দ্রব্যাদি । চন্দ্রকেতুগড়, বেড়াচাপা, হাবড়া, মাধবপুর, বারাসাতের দক্ষিণপাড়া প্রভৃতি অঞ্চল বারাসাতের প্রাচীন ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে । কিছুকাল পুর্বেই বারাসাতের দক্ষিণপাড়া অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে বিষ্ণুমুর্তি ও বৌদ্ধযুগের মৃৎপাত্র ও অন্যান্ন দ্রব্যাদি, চন্দ্রকেতুগড়তো বহু আগেই আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছে, মিলেছে সম্রাট অশোকের মৌর্য যুগ থেকে শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত প্রভৃতি যুগের ধারাবাহিক নিদর্শন যা আজ চূড়ান্ত অবহেলা ও উদাসীনতায় হাজার হাজার বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে ধুঁকছে । চন্দ্রকেতুগড় থেকে উদ্ধার হওয়া দ্রব্যাদি থেকে জানা গিয়েছে এখানে মৌর্যযুগ থেকে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ এখানে ছিল । আনুমানিক সাতশো বছর আগে এখানে রাজা চন্দ্রকেতুর রাজত্ব ছিল । স্থানীয়দের কথায়, রাজা চন্দ্রকেতু রানীর কথায় জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন। খনা জিহ্বা কেটে জ্যোতিষচর্চা ছেড়ে দিয়েছিলেন । বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এই চন্দ্রকেতুগড় ভারতবর্ষের অতি পুরানো স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম । চন্দ্রকেতুগড় থেকে বেড়াচাপা মোড় পার হলেই খনা-মিহিরের ঢিবি । যেখানে খনার বাড়ি ছিল । ১৯৫৬-৫৭ সাল নাগাদ খনার বাড়ি খনন করে পায় এক বিশাল মন্দির । শুধু তাইন নয় এখান থেকে উদ্ধার হয় ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা সিল, জাহাজ চিহ্ন, মুদ্রা সহ বহু মূল্যবান পাথর সমূহ । স্থানীয়দের কথায়, খনা ছিলেন সিংহল রাজকন্যা, জগৎ বিখ্যাত জ্যোতিষী বরাহের পুত্র মিহিরের সাথে বিবাহ হয় খনার । খনার বচন সকলের বহু কাল থেকেই পরিচিত-
“নিত্যি নিত্যি ফল খাও, বদ্যি বাড়ি না যাও।”
“যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজা পুন্য দেশ।”
ইত্যাদি।
ষোড়শ শতাব্দীতে বারাসাতের কাজিপাড়ায় থাকতে শুরু করেন পীর পয়গম্বর মহঃ একদিল শাহ্ । গৌড়ের হবশী সুলতানদের রাজত্বের শেষ সময়ে অথবা সুলতান হুসেন শাহের রাজত্বের প্রথম দিকে এই দরবেশ ইসলাম ধর্ম প্রচারার্থে এখানে আসেন বলে মনে করা হয়। শোনা যায় ইনি অনেক অলিক শক্তির পরিচয় দেন । এখানে তার স্মরনে একটি মসজিদ আছে, সেখানে তার স্মরনে বাৎসরিক মেলা হয় ।(৪)
ষোলো শতকে বারাসাত ছিল বারো ভুইঞার অন্যতম প্রতাপাদিত্যের (রাজত্বকাল ১৫৮৪- ১৬১২ খ্রিঃ) যশোহর রাজ্যের অন্তর্গত। সম্রাটের নৌসেনাপতি ও বিশ্বস্ত সুহৃদ ছিলেন শংকর চক্রবর্তী, যাঁর বাসস্থান আজও বারাসাতের দক্ষিণপাড়া অঞ্চলে বিদ্যামান । শংকর ছিল শক্তিধর ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শি। মানসিংহ মহারাজের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার জন্য ঢাকায় গুপচর পাঠান এবং নৌসেনাপতি শংকর এর কথা অবগত হন । মানসিংহ শংকরের সাথে গোপনে মিলিত হয়ে তাঁকে নিজের দলে টানার চেষ্টা করলে শংকরতা নির্ধিদায় প্রত্যাখ্যান করে । যথা সময়ে মানসিংহ আক্রমন করে, দীর্ঘ দেড় মাস (১৬১১ ডিসেম্বর থেকে ১৬১২ জানুয়ারি) যুদ্ধ হয়, পরাজিত হন প্রতাপাদিত্য ও তার সমর কুশলী শংকর । বন্দী করা হয় তাদের । আকবর পত্নী যোধাবাই -এর অনুগ্রহে আগ্রা থেকে মুক্তি পায় শংকর । ফিরে আসে নিজের বারাসাতের বাড়িতে । ভক্তিমতী যোধাবাই এর অনুরধে শুরুকরেন দুর্গা পূজা (১৬১৩ সাল), সংকল্প যোধাবাই –এর নামে । এই দুর্গা পূজা ২৪ পরগণা জেলার সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গা পূজা যা এখনো তার বংশ প্রম্পরায় হয়ে আসছে। শংকর দক্ষিণপাড়ায় “শিবের কোঠা” নামে একটি মন্দিরও নির্মান করে ছিলেন।
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে একজন বারাসাতবাসী যুবক “রামসুন্দর মিত্র” বঙ্গদেশের জমি জারিপের কাজে আকবরের ভুমিরাজস্ব মন্ত্রী টোডরমলকে সাহায্য করেন। তিনি “রায়-রায়ান” উপাধি ও গয়াজেলার জায়গীরদারী লাভ করেন। আজও তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকা মন্দির ও বৃহৎ পুকুর অতীত গৌরবের সাক্ষী । ১৬৪০ থেকে ১৬৪৫ সাল নাগাধ শেরশাহের কর্মচারী শেখ ইসমাইল বারাসাতে বাস করতেন । নবাব সিরাজদৌলা পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭ খ্রিঃ) সময় সসৈন্যে বারাসাতে এসে হাজির হন। যুদ্ধহাতি দের জল খাওয়ানোর জন্য ঐ সময় খোঁড়া হয় “হাতি পুকুর”। পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের কূটনীতিতে ইংরেজরা জয়লাভ করে। লর্ড ক্লাইভ মীরজাফরকে বারাসাত সহ ২৪ পরগণা যৌতুক দেন । ১৭৫৯ সালে ২৪ পরগণা বিধিবদ্ধ হয় । বারাসাত চলে যায় ইংরেজদের হাতে।
এই সময়ই বারাসাত নগরী রূপে প্রথম মর্জাদা পায় । বারাসাত নামটির পিছনে প্রচুর জন শ্রুতি আছে, তার মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য ও গ্রহন যোগ্য সেটি এখানে উল্লেখ করলাম । প্রখ্যাত বনিক মানিকচাঁদ জগৎশেঠের পরিবারের বারো জন সদস্য এখানে বাস করতেন। বারাসাতের কেন্দ্রস্থলে “শেঠ পুকুর” নামে পুকুরটি খোঁড়েন রামচন্দ্র জগৎশেঠ । উদ্যেস্য ছিল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং -কে খুশি করা । হয়ত “বারোশেঠ” অপভ্রহংশ হয়ে “বারাসাত” নাম হয়েছে । এই মত আরও দৃঢ় হয় বারাসাত থানার ১৯১১ সালের হর্ডিং দেখে, সেখানে লেখা হয়েছে “Baraset Police Station”। এছাড়াও বারাসাতের হাটখোলা অঞ্চলে ট্রাম ডিপোর হর্ডিং –এ “বারাশত” শব্দটি ছিল বলে প্রাচীন অধিবাসীদের অনুমান । LSS O’ Melly তার 24 Pargana District Gazetteer বইতে বারাসাত কে সর্বদা “Baraset” বলে উল্লেখ করেছেন ।
১৭৬৯ সালে জন্ প্রিন্সেপ বারাসাতে প্রথম নীল চাষ শুরু করেন, প্রথম নীল কারখানা বসে নীলগঞ্জে, তখন বাংলার অন্য কথাও নীল চাষ শুরু হয়নি । তখন সমগ্র মহাকুমা “Blue District” নামে খ্যাত হয় । বারাসাত স্টেশনের কাছে ছিল নীল পুকুর যা ছিল নীলকর সাহেবদের থাকার জায়গা । এঁদের রক্ষিতা দুই বোন চাঁপা ও ডালি যারা “চাপাডালি মোড়” নামে বেঁচে আছেন। হটাৎ ১৮৩০ সালে বারাসাতে ফরাজি আন্দোলন ডানা বাধতে শুরু করে । ১৮৩১ সালে বারাসাতের নারকেল বেড়ে (তেতুলিয়া) গ্রামে তিতুমিরের নেতৃত্বে জ্বলে ওঠে নীলচাষীদের বিদ্রোহের আগুন । তৈরি হয় বাঁশের কেল্লা । ইংরেজরা কঠোর হাতে বিদ্রহ দমন করে। বাঁশের কেল্লা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় । আন্দোলন কারিদের নিয়ে যাওয়া হয় বারাসাত জেলে (এটি বারাসাত এর পুরাতন জেল, যেটা সম্ভবত ছিল বর্তমান “কিশলয় হোম” এর জায়গায়, বর্তমানে যে বারাসাত জেল আমরা দেখি সেটা ১৯১১ সালে স্থাপিত)। সেখানে নিয়ে তাদের উপর প্রবল অত্যাচার করা হয় । সরকারি নথিপত্রে এই বিদ্রোহ “বারাসাত বিদ্রোহ” নামে খ্যাত । এটাই ভারতবর্ষের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ । এরপর ১৮৫৯ সালে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসলি ইডেন বাধ্যতা মূলক নীল চাষ বন্দের ডাক দেন।
ইংরেজদের কাছে বারাসাত ছিল সপ্তাহ শেষের প্রমোদ নগরী । গভর্নর রবার্ট ক্লাইব বারাসাতের দক্ষিণে কামার ডাঙ্গায় একটি প্রসাদপম বাড়ি করেন। ১৭৬০ সালে ভ্যান্সিটার্ট সাহেব (ক্লাইবের পর গভর্নর হন) বারাসাতে এসে ত্রিশ বিঘা আয়তন নিয়ে একটি তিনতলা বাড়ি করেন। ১৭৬৪ সালে লিম্বার্ট সাহেব “মধুমুরালী পুকুর” –এর দক্ষিণ পাশে বাড়ি করেন। এই বাড়িতে বসেই লিম্বার্ট সাহেব বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করেন । এই সময় ১৭৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ২৪ পরগণার প্রশনিক দায়িত্ব পায় । ১৭৬৪ থেকে ১৭৬৮ এর মধ্যে মিসেস লিম্বার্ট বারাসাতে “বিবির হাট” বসান যা বর্তমানে “হাটখোলা” নামে পরিচিত । ১৭৭৩ –এ লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং বারাসাতে এসে বারাসাতের উত্তরাঞ্চলে ইংলিশ স্টাইলে একটি দুতলা বাড়ি করেন, বাড়িটির মেঝে ওক কাঠের, ট্রেজারি অবধি এর সুড়ঙ্গ আছে বলে শোনা যায় । শূকর শিকার, তাস খেলা, বিলিয়ার্ড, বলড্যান্স ইত্যাদিতে তাদের সুনিবেদন হতে থাকে । তাদের বারাসাত পছন্দ ছিল আপর আর একটি কারনে তা হল, “রেসকোর্স” বা “ঘোড়ার দৌড়”, তখনো কলকাতায় “রেসকোর্স” শুরু হয়নি। ১৭৭৪ সালে বারাসাতে “রেসকর্স” চালু হয় বারাসাতের “কাছারি ময়দানে”, পরে কলকাতায় স্থান্তরিত করা হয় । ইংরেজ শাসনকালে বারাসাতে জন্মগ্রহণ করেন এন্টোনী কবিয়াল,যাকে সবাই এন্টোনী ফিরিঙ্গী বলে চেনেন, ইনি ছিলেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান । ওই সময় ইংল্যান্ড থেকে সরকারি কর্মচারি আনা শুরু হয়। নতুন আগত ইংরেজদের ভারতীয়দের সংস্কৃতি শেখানোর জন্য ১৮০২ সালে ভ্যান্সিটার্ট ভিলাতে লর্ড ওয়েলেসলি ক্যাডেট কলেজ স্থাপন করেন । বারাসাত “ The Sandhurst of Bengal” নামে খ্যাত হয় । ক্যাডেটদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে ১৮১১ সালে ক্যাডেট কলেজ বন্ধ হয়ে যায় । স্থানটি স্থানান্তরিত হয় নীলকর সাহেবের হাতে । এর পর সেখানে জেলখানা করা হয়। ১৮৮২ সালে খুলনা জেলা গঠিত হয়। সাতক্ষীরা বারাসাত থেকে খুলনায় চলে যায়।
বারাসাতে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছিল । খ্রিস্টান মিশনারিগণ খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বারাসাতে আন্তত পাঁচটি ইংরেজি বিদ্যালয় খোলেন । তখন নবজাগরণের সূচনা পর্ব । ১৮৩৯ সালে শ্রীযুক্ত প্রানকৃষ্ণ রায় তার বাড়িতে বেশ কিছু শিক্ষাবিদ মনিষিদের নিয়ে একটি ইংরাজি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। কিন্তু বারাসাতের এই শিক্ষাকেন্দ্রটি দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি বলে মনেহয়। এর পর ১৮৪৫ সালে ৫ই ডিসেম্বর পন্ডিৎ ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্যারীচরন সরকার হুগলী স্কুল ছেড়ে বারাসাতে আসেন। ১৮৪৬ সালে ১লা জানুয়ারি বারাসাতের জেলখানার একটি ঘরে “বারাসাত জেলা স্কুল” মতান্তরে “বারাসাত ইংলিশ স্কুল” স্থাপন করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন প্যারীচরন বাবু । তিনি ছাত্রদের সহজে ইংলিশ শেখানোর জন্য 1st Book of Reading এবং পরবর্তিকালে 2nd Book of Reading নামে দুটি পুস্তক রচনা করেন। এরপর মহর্ষি কালিকৃষ্ণ মিত্র অকল্পনীয় পরিশ্রমে ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কালিকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয়। সাথে ছিলেন দাদা নবিনকৃষ্ণ, হিন্দু কলেজের সহপাঠি প্যারীচরন সরকার ও পরম বন্ধু ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বারাসাতের দক্ষিণ পাড়ায় কালিকৃষ্ণের নিজের বাড়িতেই এই বিদ্যালয়ের প্রথম সূত্রপাত, ছাত্রি সংখ্যা -৩ জন । এটিই ছিল ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। তারা প্রচুর বিরোধিতা ভোগ করলেন, স্থানীয় জমিদার তাদের হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল, বাধ্য হয়ে ট্রেডর সাহেব তাদের পাহারার জন্য লোক রাখলেন । এই সময় দত্তপুকুরে অপর একজন শিক্ষানুরাগী মনিষী কালিকৃষ্ণ দত্ত বালক ও বালিকা দের জন্য নিবাদুই নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন ১৮৪৮ সালে। কালিকৃষ্ণ দত্ত ছিলেন তত্ত্ববোধিনি পত্রিকার যন্ত্রাধ্যক্ষ। মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর ও ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পৃষ্ঠপোষকতায় ও অর্থসাহয্যে এই বিদ্যালয় গড়ে ওঠে । পরবর্তি কালে সেই অর্থসাহায্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজে চালিয়েছেন।
এই সময় বারাসাতের অপর এক প্রান্তে কাজিপাড়ায় ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কাজিপাড়া একদিল শাহ্ উচ্চবিদ্যালয় । একে একে বারাসাতে গড়েওঠে একাধিক বিদ্যালয়। এরপর ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের ডাকে বিশেষ ভাবে সাড়া দেয় বারাসাত। কালিকৃষ্ণ মিত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বারাসাত থেকে ৩০০ এর বেশি মানুষ বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে সই করে, ওই লিস্টে সবার প্রথমে ছিল কালিকৃষ্ণ মিত্রের সাক্ষর। ১৮৫৬ সালে প্রথম বিধবা বিবাহ হয় গোবরডাঙ্গায়।
১৮৫৪ সালে হাটখোলায় বেসরকারিভাবে বারাসাত হাসপাতাল খোলাহয়, নাম দেওয়া হয় “বারাসাত ডিস্পেন্সারি”।১৯৬১ সালে হাসপাতাল বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বারাসাত পৌরসভা। ১৮৭১ সালে বারাসাত অ্যাসোসিয়েশন বিধিবদ্ধ ভাবে গঠিত হয়। ১৮৫৮ সাল নাগাধ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাত্র ২০ বছর বয়সে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন । তৈরি হয় ম্যাজিস্ট্রেট অফিস (পুরাতন) যা এখনও বারাসাত কর্টের পাসে বিদ্যমান । ১৮৯১ সালে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৮৮০ সালে কলকাতায় চালু হয় ঘোড়ায় টানা ট্রাম, তখন ট্রাম চলত সারা কলকাতা জুড়ে, শিয়ালদহতে ছিল ঘোড়া রাখার ডিপো। হাটখোলা লোক মুখে শোনাযায় যে ওখানে ট্রাম ডিপো ছিল। ১৮৯০ সালে কলকাতায় বিদ্যুৎ আসে, বন্ধ করে দেওয়া হয় ঘোড়ায় টানা ট্রাম, সম্ভবত ওই সময়ি বারাসাতের ট্রাম ডিপো বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৮৩ সালে বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে বারাসাত রেলপথ তৈরি করে। ১৮৯৫ সালে ১৬ই জুন ২৪ পরগণার ম্যাজিস্ট্রেট একটি বিশেষ সভা ডেকে বিপিন বিহারী মিত্র অ্যান্ড কং –কে বারাসাত থেকে বসিরহাট ষ্টীম রেলওয়ে তৈরির অনুমতি দেন এবং বলাহয় তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। ১৯০৪ সালে বারাসাত স্টেশন ঘর তৈরি হয়।
১৯০৬ সালে মার্টিন অ্যান্ড কোং কোম্পানির প্রধান কর্নধার স্যার রাজেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দৌলতে বারাসাত- বসিরহাট লাইট রেলওয়ে বসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্যার রাজেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার, যিনি হাওড়া ব্রিজ, ভেক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর মতো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পের প্রধান শিল্পী বা প্রস্তুতকারক । রাজেন্দ্রের পিতা ভগবানচন্দ্র বারাসাতের নামজাদা উকিল ছিলেন। রাজেন্দ্র বারাসাত প্যারীচরন সরকার উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন । বারাসাতের অপর এক নামকরা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ক্ষেত্রন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, যার নক্সায় বারাসাত প্যারীচরন সরকার উচ্চবিদ্যালয়ের পুরাতন বাড়িটি গড়ে ওথেছিল। যার নামে আজ বারাসাতের কেন্দ্রস্থলে কে.এন.সি রোড। ১৯১০সালে শুরুহয় নাট্যচর্চা, প্রতিষ্ঠা হয় বারাসাত ইভিনিং ক্লাব। ১৯১৪-১৫ সালে বারাসাত চ্যালেন্স কাপ খেলা শুরু। ১৯২০সালে মুঘল আমলের সরাইখানার নাম বদলে রাখা হয়“ডাকবাংলো মোড়”, সেখানে হত কোকো চাষ। ১৯২১ সালে বারাসাতের ভাগীরথী চট্টোপাধ্যায় আসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন, প্রকাশিত হয় বারাসাতের প্রথম দৈনিক পত্রিকা “পল্লিবার্তা” । ১৯২৫ সালে বারাসাত থেকে শ্যামনগর প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয়। ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু বারাসাতে আসেন। প্রতিষ্ঠা হয় বারাসাত ছাত্র ফেডারেশন এর পরিশ্রমে “বারাসাত বালিকা বিদ্যালয়”। এই ছোটো জাগুলিয়ার প্রিয়নাথ বসুর সার্কাস ভারতের প্রথম সার্কাস। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বারাসাতের প্রথম সীনেমা হল “ছায়াবানী সিনেমা হল”। ১৯৪৭ সালে গান্ধীজী ও শহিদ সুরাবর্দি বারাসাত “রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়” প্রাঙ্গনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ, গঠন হয় নতুন সরকার। এর কিছুকাল পর ১৯৬৭ সালের মে মাসে শুরু হয় নক্সাল আন্দোলন। ১৯৭০ সালে ১৯ নভেম্বর বারাসাতের আমডাঙ্গায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গুলি বিদ্ধ করে মারা ১১টি যুবকের মৃতদেহ সার সার অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় পাওয়া যায়। পরে জানা যায় এরা বরানগর-দক্ষিণেশ্বর অঞ্চলের নক্সালপন্থী যুবক। পুলিশ তাঁদের প্রথমে গ্রেফতার করে। অনেকের অনুমান পুলিশ পরে ইন্কাউন্টারের অজুহাতে হত্যা করে। একমাস পর আমডাঙ্গা ঘটনার তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বা প্রাক্তন বিচারপতি তারাপদ মুখোপাধ্যায় উপর হামলা হয়, তিনি কোনোরকমে বেচে ফেরেন। তার পর তদন্ত চাপা পড়ে যায়। এদিকে তখন চলছে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন, আন্দোলনে সাহায্য করে ভারত। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশের জনগণদের ভারতে আনার ব্যবস্থা করা হয়, বারাসাতের বিভিন্ন স্থানে উৎবাস্তু ক্যাম্প গঠন করা হয়েছিলো ।
বারাসাতের অনেক গুরুত্বপুর্ন ইতিহাস আছে, কিন্তু পাঠ্য পুস্তকে তিতুমিরের “বারাসাত বিদ্রোহ” ছাড়া অন্য কোন কিছুই সেভাবে প্রকাশ হয়নি, যা নিতান্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু একথা সত্য যে, বারাসাত ভারতের অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ন স্থান। আমরা যারা বারাসাত বাসি তারা এই দিক থেকে বারাসাত বাসি হিসাবে অনেক গর্ব অনুভব করি।
তথ্যসুত্রঃ
১। আরুনকুমার ঘোষ এর মুমূর্ষু সুটী নদী – সারাংশ পত্রিকা– ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ।
২।এই নগর, এই জনপদ (প্রবন্ধ)– মৈত্রেয়ী গুপ্ত – হিন্দোল ।
৩।চন্দ্রকেতুগড় – শ্রী দিলিপ মৈতে
৪। বাংলার পীর সাহিত্যের ইতিহাস – ডঃ গিরিন্দ্রনাথ দাস
৫। বারাসাতের সুধিজন (দ্বিতীয় পর্ব) – হর্ষবর্ধন ঘোষ
৬। প্যারীচরন সরকার – শ্রী নবকৃষ্ণ ঘোষ
৭। মহর্ষি কালিকৃষ্ণ মিত্র – শ্রী নবকৃষ্ণ ঘোষ
৮। গ্রাম বাঙলা ও বারাসাতের ইতিকথা – শ্রী আক্ষয় কুমার মুখোপাধ্যায়
৯। প্রসঙ্গ বারাসাত – ডঃ রনতোষ চক্রবর্তী
১০। 24 Pargana District Gazetteer –LSS O’Melly
১১। সাবেক কলকাতার ইতিহাস – সমীর চট্টোপাধ্যায়
১২। কোলকাতার দিনলিপি –
১৩। কৌশিক দত্ত –এর প্রবন্ধ “অবহেলিত উপেক্ষিত বারাসাতের ইতিহাস ও ইতিহাসচর্চা” –সারাংশ পত্রিকা -১৬ ডিসেম্বর ২০১৪।
১৪। রাজধানী কলকাতা থেকে শহর কলকাতা –কালিদাস হাজরা ।
১৫। নির্মান কাহিনী (প্রবন্ধ) –তরুণ রাণা -৩৬৫ দিন –রবি -১৫ জুলাই ২০১২।
Source : academia.edu