লেখকঃ সৌরভ বারুই
কিংবদন্তি খনা ও তাঁর ঐতিহাসিক অনুসন্ধান(প্রকাশিতঃ সপ্তডিঙ্গা পত্রিকা। (ISSN 2395-6054), বর্ষা সংখ্যা, ১৭ই আগস্ট ২০১৬। ৩২শে শ্রাবণ ১৪২৩)
খনার ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কারো কাছে খনা সিংহলীয় বা কারো কাছে বারাসাত বাসী আবার কারো কাছে উড়িষ্যার লীলাবতী। খনার একাধিক ভিন্ন কিংবদন্তীয় জনশ্রুতি রয়েছে। ফলে সঠিক ঐতিহাসিক অনুসন্ধান হয়ে পড়েছে প্রায় অসাধ্য। আসলে খনাকে নিয়ে ঐতিহাসিক কোন প্রমাণাদি পাওয়া যায়না। লোকমুখে প্রচারিত বিশেষ করে সেই সময়ের বহুল সমাদৃত কথকরাই মূলত খনার বচনকে লোকমুখে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নাম হয়েছে “খনার বচন”।
খনাকে আমরা প্রাচীন বিদুষী, বাঙ্গালী নারী রূপেই বুঝি। যিনি ছিলেন একাধারে জ্যোতিষবিদ, গণিতজ্ঞ এবং কবি। বাংলা আঞ্চলে কথিত আছে শুভক্ষণে জন্মগ্রহণ করার কারনে তাঁর নাম “খনা” বা “ক্ষনা”। আবার উড়িয়া ভাষায় “খন” বা “খোনা” শব্দের অর্থ বোবা। উড়িষ্যায় প্রচলিত আছে মিহির তাঁর স্ত্রী লীলাবতীর জিব কেটে দেন বলে তাঁর (লীলাবতীর) নাম হয় “খোনা”। আবার অনেক পন্ডিত মনেকরেন “খনার বচন” যেহেতু আবহাওয়া, দিনক্ষণ এর সাথে জড়িত, তাই “ক্ষন” থেকে “খন” হয়ে “খনা” নামটির উৎপত্তি। খনার কোনো লিখিত ইতিহাস না থাকায় জোরালো ভবে বলা যায় না যে “খনার বচন” খনা নামের কোনো বিদুষী নারীর রচিত লোকশাস্ত্র। খনার সম্বন্ধে আমাদের অনুসন্ধান যেহেতু “খনার বচন” কে কেন্দ্রকরে, তাই খনার ইতিহাস খোজার প্রধান সুত্র হওয়া উচিৎ “খনার বচন”। কিন্তু খনা সম্পর্কে জনশ্রুতির এতো ব্যাপক প্রসার যা খনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য অনুসন্ধানে যতটা সহায়তা করে আবার ঠিক ততটাই অসহযোগী হয়ে সামনে এসে দাড়ায়। তাই বিভিন্ন কিংবদন্তীদের পাশে রেখে “খনার বচন” কে কেন্দ্র করে বাংলার ইতিহাসকে পথ প্রদর্শক করে খনার প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধান করায় বোধহয় সমীচীন হবে।
প্রথমে খনার সময়-কাল নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। অনুমান করা হয় খনার সময়-কাল ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ। যদিও বরাহ(৫০৫-৫৮৭) যদি খনার শ্বশুর হন তবে খনার আরও কয়েক শতক আগে জন্ম হওয়া উচিৎ। কিন্তু এদিকে “খনার বচন” গুলির ভাষা, আঙ্গিক ও বাক্য গঠনের রীতি দেখে ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতামত “বচন” গুলির প্রাচীনত্ব চারশত বছরের বেশি হবে না। এটা ধরে নিলে খনার জীবনকাল ৮০০-১১০০ এর থেকে আরও কয়েক শতক পরে হওয়ার কথা। তবে এটা সম্ভব যে “বচন” গুলির ভাষা কালের নিয়মে পরিবর্তিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে কারন সেগুলি শ্রুতি রূপেই প্রচলিত ছিল। খনার বচন গুলিকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় “বচন” গুলি যে সময় রচিত, সে সময় এদেশে কৃষি এবং গোপালনের উপর সমান গুরুত্ব ছিলো। এছড়াও “বচন” গুলিতে মহিষ এবং মোরগের কথা উল্লেখ নেই। এর দ্বারা মনে করা যেতে পারে “বচন” গুলি এমন সময় রচিত হয় যখন মহিষ-মোরগ গৃহপালিত পশু বা পাখী রূপে প্রাধান্য লাভ করেনি। তাই অধিকাংশ পন্ডিতরা মনেকরেন “খনার বচন” এর রচনা কাল হয়তো গুপ্ত সাম্রজ্যের সময়ে। অর্থাৎ খনার জীবনকাল গুপ্তযুগের, কিংবদন্তি সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সমসাময়িক।
খনাকে নিয়ে তৈরি সব কিংবদন্তিদের একটি সাধারণ সুতোয় বাধলে একটি গল্প পাওয়া যায় যাকে ইতিহাসের সুতোয় বাধার চেষ্টা করবো। প্রথম কিংবদন্তীতে দেখাযাচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী নগরের (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী)রাজা রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের (আনুঃ ৫০০ খ্রীষ্টাব্দ) পুত্র জন্মগ্রহণ করলে, তিনি পুত্রের কোষ্ঠি বিচার করে দেখেন তাঁর শিশু পুত্রের আয়ু মাত্র এক বছর। বরাহ হতাশ হয়ে পড়েন, পুত্রের চিন্তা সহ্য করতে না পরে তিনি একটি পাত্রে করে পুত্রকে নদীর শ্রতে ভাসিয়ে দেন। এর পর শুরু হচ্ছে অপর এক কিংবদন্তিলীলাবতীর কথা। ইতিহাস বলে বরাহ এবং মিহির একই ব্যাক্তি ছিলেন। মিহির দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা কিংবদন্তিবিক্রমাদিত্যের কাছ থেকে বরাহ উপাধি পেয়েছিলেন। খনা তাঁর বচনে উল্লেখ করেছেন যে তাঁর শ্বশুর বরাহ। তবে তিনি নিশ্চই বরাহের পুত্রবধূ। কিন্তু বরাহ বা মিহির বা বরাহমিহির যদি একই ব্যাক্তি হন তবে খনার স্বামী কে? অনেক পণ্ডিতদের মতে বরাহমিহিরের পুত্রের নাম “পরাশর”। “পরাশর”-ও ছিলেন একজন জ্যোতিষবিদ। তবে কি “পরাশর” ছিলেন খনার স্বামী? নাকি বরাহ ও মিহির ভিন্ন ব্যাক্তি, অথবা কিংবদন্তিরূপে মিহির সত্যই বরাহের পুত্র। কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার নবরত্নদের মধ্যে বরাহমিহির কে একজন ব্যাক্তি রূপেই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে মিহিরের “বরাহ” হয়ে ওঠার পিছনে গল্পটা একটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন। সম্রাট “দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত”-র পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহন করলে মিহির রাজকুমারের কুষ্টি বিচার করে বললেন তাঁর পুত্র ১৮ বছর বয়সে মারা যাবে। ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হল। আঠেরো বছর বয়স হতেই এক শুকরের আঘাতে মৃত্যু হল রাজকুমারের। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মিহিরের এই জ্যোতিষ গুন দেখে তাকে মগধের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার “বারাহ” উপাধিতে ভূষিত করলেন। গল্পের প্রথম ভাগটি অনেকটা খনার কিংবদন্তিগুলোর মত। তবে এমন নয় তো। যে খনার কিংবদন্তিগুলি ভ্রান্ত কিছু গল্প মিশিয়ে তৈরি করা।
লীলাবতীর কিংবদন্তীতে দেখা যাচ্ছে একদল রাক্ষস লঙ্কার রাজা আর রানীকে মেরে লঙ্কা নগরী দখল করে এবং রাজকন্যাকে তারা লালন পালন করতে শুরু করে। ওদিকে বরাহের ভাষিয়ে দেওয়া পুত্রকে নদীতে ভেসে আসতে দেখে নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে অপর এক রাক্ষস সম্প্রদায়। কিন্তু সে শিশু অর্থাৎ বরাহের পুত্র মিহির আর মারা যায় না, বড় হতে থাকে রাক্ষসদের মধ্যেই। মিহির এবং রাজকন্যা লীলাবতী দুজনেই ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে। ষোলো বছর বয়সে মিহির রাজকন্যার প্রেমে পড়েযায়। রাজকন্যাকে বিবাহ করে অবন্তীর পথে যাত্রা করে। প্রাচীন বাঙালি জ্যোতিষী প্রজাপতি দাসের পঞ্চস্বর ও ষষ্ঠী দাসের গ্রন্থে “খনার বচন”-এর উল্লেখ দেখা যায়। এখানেও তাঁর পরিচয় অস্পষ্ট। প্রজাপতি দাসের গ্রন্থে খনার পরিচয় কখনো খনা আবার কখনো লীলাবতী। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন বাংলা তখন গিঙ্গারিডি বা রাঢ় নামেই পরিচিত ছিল। গঙ্গারিডি ছিলো খুব শক্তিশালী। বহিরাগতরা বাংলা তথা গঙ্গারিডিতে বা রাঢ়ে প্রবেশ করতে পারতোনা। অনেক পন্ডিতের মতে প্রাচীন ভারতে আর্যরা বাংলায় প্রবেশ করতে না পারায় তারা বাংলা বাসীদের রাক্ষস, বানর ইত্যাদি পরিচয়ে ভূষিত করেছিলো যার উল্লেখ রামায়নে পাওয়া যায়। এই রাক্ষসরাও হয়তো লঙ্কার রাক্ষস নয় বঙ্গঃ রাক্ষস। মধ্যযুগীয় কিছু বর্ণনায়, যেমন কালহানের রাজতরঙ্গিনীতে, বাংলার গৌড়কেই অবশ্য রাক্ষস রাজ্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। হয়তো লঙ্কার কথা কখনই ছিলো না। রামায়ণ, মহাভারতের বর্ননাতে রাক্ষস বলতে লঙ্কাবাসীদের বোঝানো হয়েছে সেই সুত্রে রামায়ণের প্রভাবে বাংলার মানুষেরা রাক্ষস বলতে লঙ্কার রাক্ষসের কথা ভেবে নিয়েছে। আসলে তারা (খনা ও মিহির) বাংলাতেই লালিত পালিত হয়েছিলো। অপরদিকে আবার সিংহলে বৌদ্ধদের রচিত “দ্বীপবংশ”, “মহাবংশ”, “কুলবংশ” প্রভৃতি সংহলীয় গ্রন্থ থেকে জানা যায় রাজা বিজয় সিংহের ইতিহাস। যিনি ছিলেন রাঢ়ের শাসনকর্তা সিংহপুরের রাজা সিংহবাহুর পুত্র। বিজয় ছিল খুব অত্যাচারী। তাঁর অত্যাচারে অতিস্ট হয়ে প্রজারা রাজার কাছে নালিশ করলে রাজা সিংহবাহু বিজয় কে নির্বাসন দেন। বিজয়কে একটা জাহাজে তুলে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেন। জাহাজে বিভিন্ন যায়গা ঘুরে শেষে লঙ্কা নগরী তে এসে উপস্থিত হয় (৫৪৩ খ্রিস্টপুর্ব)। শ্রী শ্যামচরন শ্রীমাঁনী প্রণীত “সিংহল বিজয় কাব্য”-এ দেখা যাচ্ছে বিজয় তাম্রপর্ণী দ্বীপের (তাম্রপর্ণী দ্বীপ -কে পন্ডিতেরা বর্তমানের শ্রীলঙ্কা বলে থাকেন) সম্রাট যক্ষরাজ কালসেন কে যুদ্ধে পরাজিত করে কালসেনের কন্যা কুবেণীকে বিবাহ করেন এবং দখল করেন তাম্রপর্ণী দ্বীপ। “তাম্রপর্নী দ্বীপ” –এর নাম পরিবর্তিত করে রাখেন “সিংহল”। অনেক পণ্ডিতের মতে খনা হয়ত এই বংশেরই কোন দুর্ভাগা কন্যা। বংশ পরম্পরায় যার মাতৃ ভাষা ছিল বাংলা। তাছাড়া সিংহলী ভাষার সাথে বাংলা ভাষার মিলটাও লক্ষ্যনীয়। তবে বিজয় সিংহের বংশধররা ঠিক কত শতাব্দী রাজত্ব করেছেন তাঁর কোন সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। কিন্তু অপর দিকে “তাম্রপর্নী দ্বীপ” নামটি অপর এক সমস্যার সৃষ্টি করে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, দক্ষিণ ভারতে “তাম্রপর্নী” নামে একটি প্রাচীন নদী ছিলো। লক্ষ্মণসেনের রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম সংস্কৃত কবি ধোয়ী (১২শ শতক) তাঁর রচনায় “তাম্রপর্নী নদী” –র উল্লেখ করেছেন। যা দক্ষিণ ভারতে নদী। এছাড়া ভারতের অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থেও এর উল্লেখ দক্ষিণ ভারতের নদী রূপেই। তবে “তাম্রপর্নী” দ্বীপ বলতে কোন অঞ্চলকে বোঝাচ্ছে? এ নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দক্ষিন ভারতের চোল বংশের ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, প্রথম রাজারাজ চোল ৯৯৩ সালে সিংহল আক্রমন করেন। তখন সিংহলে পঞ্চম মাহিন্দারের শাসন চলছিলো। “খনার বচন” এর বৈশিষ্ট গুলি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় “বচন” গুলি প্রায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমসাময়িক। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কাল ৩২০ খ্রিষ্টপুর্ব থেকে ৬০০ অব্দ পর্যন্ত ধরা হয়। সুতরাং মনেকরা যেতে পারে যে খনার কিংবদন্তিগুলিতে সিংহলে যে বহিরাক্রমনের উল্লেখ আছে তা হয়তো প্রথম রাজারাজ চোল দ্বারা ঘটিত আক্রমন। অর্থাৎ খনার জীবন কাল প্রায় ৯০০ থেকে ১০০০ অব্দের ভেতরে এবং কিংবদন্তিঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু তাতেও প্রশ্ন থেকে যায়, যে খনা কি তবে সিংহল রাজ মাহিন্দার কন্যা! কিন্তু “খনার বচনে” যে উল্লেখ আছে-
“আমি অটনাচার্যের বেটি
গনতে গাঁথতে কারে বা আঁটি”
অর্থাৎ “আমি অটনাচার্যের কন্যা/ খনা গণনা ও গাঁথা রচনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী”। তবে কি খনা মিথ্যা বললেন! নাকি মাহিন্দা এবং অটনাচার্য অভিন্ন ব্যাক্তি। এই প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায় নি। খুজে পাওয়া যায় না অটনাচার্যকেও। কিন্তু “অটনাচার্য” নামটিকে ভালোভাবে লক্ষ করলে বোঝাযায় এই নামটিতে শিক্ষিতের ছাপ রয়েছে। “অটনাচার্য” অর্থাৎ “অটন” “আচার্য”। “অটন” শব্দের অর্থ পর্যটক বা ভ্রমনকারী এবং “আচার্য” শব্দের অর্থ শিক্ষাগুরু। অর্থাৎ “অটনাচার্য” হয়তো একজন ভ্রমনকারী শিক্ষাবিদ ছিলেন। অর্থাৎ কোনো দেশের রাজা হওয়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু কিংবদন্তিঅনুসারে খনা রাজার কন্যা। আবার এও হতে পারে “অটনাচার্য”কে নিজের পিতা বলতে তিনি নিজের কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। খনার বচন গুলির তথ্য গুলি প্রমান করে খনাকে যথেষ্ট ভ্রমণ করে সমস্ত বচনগুলির রচনা করতে হয়েছিল। সুতরাং একথা বলাও সমীচীন হবে যে খনা ভ্রমণ প্রিয় রমণী ছিলেন। তাই তিনি “অটনাচার্য” বলতে তাঁর বচনে তাঁর কর্ম ক্ষেত্রের উল্লেখ করেছেন। “আমি অটনাচার্যের বেটি” বচনটির সাথে “গনতে গাঁথতে কারে বা আঁটি” বচনটি যুক্ত হওয়ায় কর্মক্ষেত্রের প্রসঙ্গটি আরও প্রমান সিদ্ধ হয়েছে।
১১৫০ সালে ভারতীয় গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাস্কর কর্তৃক রচিত একটি গণিত শাস্ত্র “লীলাবতী”-র কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এই শাস্ত্রেও “লীলাবতী” সম্পর্কে বিভ্রান্তির শেষ নেই। অনেক পন্ডিত এই “লীলাবতী”কে খনা বা খনার অপর এক কিংবদন্তী(যার নাম “লীলাবতী”, যার স্থান উড়িষ্যা) বলে মনেকরে থাকেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে “লীলাবতী” ছিলেন দ্বিতীয় ভাস্কর বা ভাস্করাচার্যের কন্যা। যে অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে পিতাঁর কাছে এসে থাকতে শুরু করেন। আর তাঁর পিতা (দ্বিতীয় ভাস্কর) তাকে গণিতবিদ্যা শিক্ষাতে লাগলেন। এই লীলাবতীর সাথে জিব কর্তনের কোনো উল্লেখ নেই। আবার কোনো ঐতিহাসিকের মতে “লীলাবতী” দ্বিতীয় ভাস্করের কন্যা নন, তাঁর স্ত্রী। আবার কেউ বলেন “লীলাবতী” আসলে শুধুমাত্র একটি গণিত শাস্ত্রই, “লীলাবতী” আসলে তাঁর কল্পনা। দ্বিতীয় ভাস্কর লীলাবতী রচনা করেন বিজাপুরে (বর্তমান ভারতের কর্নাটক) বসে। আপর দিকে কিংবদন্তিলীলাবতী উড়িষ্যায়। সুতরাং দ্বিতীয় ভাস্করের “লীলাবতী” এবং খনার কিংবদন্তি“লীলাবতী” একই ব্যাক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
অপর এক কিংবদন্তীতে খনার বাসস্থান নিয়ে ভিন্নমত। এই কিংবদন্তীতে খনার জন্মস্থান বারাসাতের দেগঙ্গা থানার অন্তর্গত দেউলী গ্রামে। দেউলী আসলে রাজা চন্দ্রকেতুর শাসনকালের একটি গড়। রাজা চন্দ্রকেতুর শাসনকালে এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায় তাই “দেউলী” নাম। এখানে রাজবাড়ির অদূরে একখণ্ড জমিকে “বরাহমিহিরের বাস্তু” নামে লোকে অভিহিত করে থাকে। এখানে আছে “খনা মহিরের টিবি”। কিংবদন্তিঅনুসারে রাজা চন্দ্রকেতু পূজার সময় নরবলি দিতেন ও তাঁরই রোধকল্পে গোরাচাঁদ পীর চন্দ্রকেতু আক্রমণ করেন এবং রাজা ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করেন, অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় গোরাচাঁদ পীর(১২৬৫-১৩৭৩) দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চন্দ্রকেতু স্বপরিবারে আত্মহত্যা করেন এ কথার উল্লেখ দেখা যায়। যদি কিংবদন্তিঅনুযায়ী চন্দ্রকেতু যদি গোরাচাঁদ পীরের কারণে মারা যায় তবে খনা নিশ্চই রাজা চন্দ্রকেতুর চেয়ে অনেক প্রাচীন। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত আর্কেওলজি অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ২৪ পরগণার লোকদের খনার বচন অনুসারে কৃষি পদ্ধতি, গাছ রোপণের ব্যাপকতা এবং বাসস্থান নির্মাণের কৌশল দেখে মনে হয় খনার বাসস্থান ২৪ পরগণাতেই ছিলো। খনার ঢিপি থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা গেছে এগুলো গুপ্তযুগের। অর্থাৎ খনার জন্মস্থান বারাসাতের দেউলী গ্রামেও হতে পারে আথবা সিংহল থেকে খনা-মিহির প্রথম বাংলাতে চন্দ্রকেতুগড়ে এসে থাকতে শুরু করে।
এর পরবর্তি কিংবদন্তিগুলির গল্প প্রায় একই রকমের। খনা এবং মিহির উভয়েই জানতে পারে যে মিহির আসলে বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ বরাহের পুত্র। বারাসাতের কিংবদন্তীর ক্ষেত্রে দ্যাখা যাচ্ছে খনা এবং মিহির দুজনেই রাজা ধর্মকেতুর (চন্দ্রকেতুর পুর্বপুরুষ) রাজ জ্যোতিষী হিসাবে নিযুক্ত হন। তাঁর পর মিহির তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে। জানা মাত্রই তারা অবন্তীতে চলে আসে। বরাহের সাথে দ্যাখা হয়। বরাহ অবাক হয়ে যান, যে পুত্রের এতদিনে মারা যাওয়ার কথা সে কি ভাবে এতদিন বেচে আছে। তখন খনা তাঁর “বচন” শোনান।
“কিসের তিথি কিসের বার
জন্ম নক্ষত্র কর সার।
কি কর শ্বশুর মতিহীন
পলকে আয়ু বারো দিন।”
অর্থাৎ মিহিরের আয়ু এক বছর নয় ১০০ বছর। তখন বরাহ বুঝতে পারেন যে খনা জ্যোতিষ বিদ্যায় অসীম ক্ষমতাশালী। বরাহ তাঁর পুত্রবধূকে মেনে নেন। কিন্তু মেহেরপুরের (বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল) ইতিহাসে খনা ও মিহিরের কথা পাওয়া যায়। মেহেরপুরের প্রাচীন নাম মিহিরপুর, মিহিরপুর নামটি মিহির থেকে এসেছে বলে অনেক পন্ডিত মনেকরে থাকেন। পন্ডিতদের মতে খনা-মিহির মেহেরপুরে এসে কিছুকাল বসবাস করেছিলেন, কিন্তু বিবাহের আগে না পরে তা তারা বলেননি। কিন্তু মেহেরপুরের ইতিহাসে দেখাযায় ইসলাম প্রচারক দরবেশ মেহের আলী নামের এক জনৈক ব্যাক্তি মেহেরপুর শহর স্থাপন করেন।এবং তাঁর নামেই এই অঞ্চলের নাম হয় মেহেরপুর।
এর পর রাজা চন্দ্রগুপ্ত কোনোভাবে খনার কথা জানতে পারেন। খনাকে ডেকে পাঠান নবরন্ত সভায়। খনা সভায় তাঁর জ্যোতিষ তত্ত্বে বরাহমিহির কে পরাজিত করেন। চন্দ্রগুপ্ত খনার জ্যোতিষ প্রজ্ঞা ও গাণিতিক জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে সভায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। বরাহ প্রবল ঈর্ষান্বিত হয়ে মিহিরকে বলেন খনার জিহ্বা কেটে দিতে, যাতে খনা কোনোদিন কথা না বলতে পারে। পিতাঁর আদেশে মিহির খনার জিহ্বা কেটে দিলে, প্রবল রক্তপাতে খনার ম্রিত্যু হয়। উড়িষ্যার কিংবদন্তীতে এই একইরকম ঘটনা। মিহির “লীলাবতী”-র জিহ্বা কেটে “খোনা” করে দিলে লীলাবতী “খনা” রূপে পরিচিতি লাভ করেন। অপর এক কিংবদন্তীতে আছে, খনার জিহ্বা কেটে ফেলার আগে খনাকে কিছু বলার সুযোগ দিলে খনা তখন তাঁর বচন গুলি শোনান। হয়ত তখনই কেউ বচনগুলি লিপিবদ্ধ করেন বা স্মরনে রেখে পরে প্রচার করেন। আবার কোনো কিংবদন্তীতে আছে বরাহ নিজের সুনাম, প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে নিজেই খনার জিহ্বা কেটে দেন। এর কিছুকাল পর খনার ম্রিত্যু হয়। চন্দ্রগুপ্তের নবরন্ত সভায় যেহেতু বরাহমিহির বলতে একজনকেই বোঝানো হয়েছে। সুতরাং মিহিরের হাতে খনার জিহ্বা কাটার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা, তাই মনেকরা যেতেপারে যে, বরাহমিহির নিজেই খনার জিহ্বা কর্তন করেছেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত বা বরাহমিহিরের সমগ্র জীবনের কথাও খনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাই খনার নবরত্ন সভায় উপস্থিৎ হওয়ার প্রসঙ্গ অনৈতিহাসিক। যদি খনার উপস্থিতি মেনে নেওয়া হয় তবে প্রশ্ন থেকেই যায় খনার ম্রিত্যু কীভাবে হল? অনেক পন্ডিতের মতে খনা ছিলেন একজন চার্বাক দার্শনিক। চার্বাক দের মত খনাও পরলোক তত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন। খনার বচনে আমরা সর্বত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ করি। খনার বচনে কথাও কোন কুসংস্কারের সমর্থন নেই। খনার বচনে আছে –
“সোমে ও বুধে না দিও হাত
ধার করিয়া খাইও ভাত”
চার্বাকরা বলতেন “ধার করে হলেও ঘি খাও”। খনা চার্বাক হওয়ার কারনে হয়তো তাকে ধার্মিক শ্রেণীর কেউ হত্যা করেছে। অবশ্য এটা সম্পুর্ন অনুমান সাপেক্ষ। কিন্তু খনার ম্রিত্যু নিয়ে কিংবদন্তীয় কাহিনী গুলির সাপেক্ষে ইতিহাস নীরব। যদি খনা বলে সত্যিই কোনো নারী থেকে থাকেন তবেই মারা সম্ভব। তবে কি “খনার বচন” বলতে “ক্ষন” বা “সময়ের বচন”।
খনা যে সময়ে জীবিত ছিলেন (আনুঃ ৯০০-১২০০) তখন ভারত ছিল পুরুষ শাসিত সমাজ। সেকালে নারীদের তেমন মর্যাদা দেওয়া হত না। তবে এমন নয়তো যে, খনার কবিত্ব, জ্যোতিষ চর্চা, গাণিতিক জ্ঞান সেকালের পুরুষ শাসিত সমাজ সর্ব সমক্ষে প্রচার করতে চাননি। তাই কোন গ্রন্থে খনার নাম উল্লেখ করেননি। মহাকবি কালিদাস বীরোচিত “জ্যোতির্বিদ্যা ভরণ” গ্রন্থে দ্বিতীয় চন্দ্রগপ্তের রাজ সভার নবরত্নদের নাম পাওয়া যায়-ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ, শঙ্কু, বেতালভট্ট, ঘটকর্পর, কালিদাস, বরাহমিহির, বররুচি। এরা প্রত্যেকেই পুরুষ। তবে সম্পুর্ন দেশে একজন নারী রত্ন ছিলো না? এর কোনো উত্তর নেই। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে কালি দাস ইচ্ছ করে কখনো খনার নাম তাঁর রচনায় উল্লেখ করেননি। হয়তো কালিদাসের সময়ে খনা আসেন নি। সে যাই হোক, “খনার বচন” আর কিছু অনৈতিহাসিক কিংবদন্তিছাড়া খনার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এটা প্রমান সিদ্ধ হয় না যে খনা বলে কেউ ছিলেন না।
খনাকে নিয়ে ঐতিহাসিক অনুসন্ধান যে কতোটা দুর্বিসহ, আশাকরি পাঠকের সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা। খনার বচনের বিস্তৃতি বাংলা, উড়িষ্যা, কেরল, শ্রীলঙ্কা সহ ভারতের প্রতিটি রাষ্ট্রেই রয়েছে। ফলে খনার জীবন নিয়ে সংশয় বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। খনা যদি সত্যিই থেকে থাকেন তবে এক সেকালের পুরুষ শাসিত সমাজ তাকে অস্বীকার করেছেন, নয়তো খনা কোন বড়ো মাপের জ্যোতির্বিদ ছিলেনই না, তাঁর কিংবদন্তিগুলি অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট। আর যদি খনার উপস্থিতি অস্বীকার করা হয়, তবে অপর এক প্রশ্ন এসে ডানা বাধে- “খনার বচন” কার রচনা? খনা সম্পর্কিত অধিকাংশ গবেষকরাই খনাকে লীলাবতী (উড়িষ্যার কিংবদন্তী) রূপে ধরে নিয়েছেন। লীলাবতীর উপস্থিতির কোন নিদর্শন উড়িষ্যাতে নেই। আছে বারাসাতের দেউলী গ্রামে, যেখানে খনা “লীলাবতী” নয় “খনা” নামেই পরিচিত। আবার অনেকের মতে খনার বচন কোনো একজন ব্যাক্তির রচনা নয়। কালের নিরিখে বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর আয়তন এবং সংখ্যা। অনেকের কাছে খনার বচনের সংখ্যা ১০০০ এরও বেশি আবার কারোও কাছে ১৫০টির মতো। “খনার বচন” নিয়ে যখন যেই ব্যাক্তি গ্রন্থ রচনা করেছেন তখন তিনি খনার জীবন সম্পর্কে নিজের মতামত উল্লেখ করেছেন, ফলে আড়ালে রয়েগেছে খনার প্রকৃত পরিচয়। কিন্তু কখনই একথা অস্বীকার করা যায় না, খনার উপস্থিতি থাকুক আর নাই থাকুক “খনার বচন” বাংলার তথা সমগ্র ভারতের একটি প্রাচীন বৈজ্ঞানিক লোকশাস্ত্র এবং এর রচনাকার একজন (বা একাধিক) বিজ্ঞানী।
তথ্যসূত্রঃ
১। “Varahamihira: The ancient astrologer, astronomer and mathematician” by Meera Sashithal; The Free Press Journal; (Weekly News Paper); Oct 3; 2015।
২। বাংলা পীর সাহিত্যের কথা – ডক্টর গিরীন্দ্রনাথ দাস।
৩। মহাবংশ বা মিশ্রগ্রন্থ (পালি) – ধ্রুবানন্দ মিশ্র।
৪। কিংবদন্তিখনা ও খনার বচন – লেখিকা পূরবী বসু।
৫। ভারতের ইতিহাস (মধ্যযুগ) – তেসলিম চৌধুরী।
৬। ভারতবর্ষের ইতিহাস (আদি যুগ) – গোপাল চন্দ্র সিন্হা।
৭। সিংহল বিজয় কাব্য – শ্রী শ্যামচরন শ্রীমাঁনী।
৯। প্রাচীন বাংলার গৌরব – শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
১০। Bhaskaracharya’s Lilavathi –by Nithin Nagaraj।
১১। Our Scientists by Dilip M. Salwi।